
যেকোনো মৃত্যুই বেদনাদায়ক। তবে বিভুরঞ্জন সরকার যেহেতু পত্রিকায় খোলা চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছেন ফলে এই মৃত্যুর একটি রাজনৈতিক দিক আছে যা তার সাংবাদিক জীবনের ভূমিকা ও খোলা চিঠি তথা সুইসাইড নোটকে পর্যালোচনা করার দাবি রাখে।
বিভুরঞ্জন তার খোলা চিঠির প্রথম প্যারায় লিখেছেন, “এই দীর্ঘ সময় আমি লিখেছি সত্যের পক্ষে, মানুষের পক্ষে, দেশের পক্ষে। কিন্তু আজ, যখন নিজের জীবনকে দেখি, অনুভব করি—সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়।”
বিভুরঞ্জন সরকারের দীর্ঘ সময়ের লেখা আমি পড়িনি তবে অন্তত বিগত ১০ বছরের লেখা পড়েছি। এই সময়ে উনার যেসব লেখা পড়েছি সেগুলো ছিল আওয়ামীলীগের পক্ষে, শেখ হাসিনার পক্ষে, ফ্যাসিবাদের পক্ষে ও বাংলাদেশের বিপক্ষে। উনি এখানে একটি আপ্ত বাক্য জুড়ে দিয়েছেন যে সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়। এই কথাটি আসলে সত্য, অনেক সময়ই মানুষকে সত্য বলার জন্য, লেখার জন্য জীবন দিতে হয়, কিংবা বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু কারো জীবন কঠিন হয়ে গেলে এবং কেউ হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করলেই এটা প্রমাণ করেনা যে তিনি সত্য লিখতেন।
বিভুরঞ্জন সত্য লিখতেন না। তিনি বাংলাদেশের মানুষের মানবাধিকার হরণ ও ভোটাধিকারহীনতার বিরুদ্ধে লেখেননি। বরং ফ্যাসিবাদের হাতকে আন্তরিকতার সাথে শক্তিশালী করেছেন। তবু অবাক করার বিষয় যে তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর আগেও ভাবছেন যে তিনি সত্য লিখতেন। এটা আসলে চেতনার ভ্রান্তি। আর সত্য তো বহুবিধ হয়। অন্ধবিশ্বাসীদের তাদের ধর্ম যদি বলে গরু আকাশে উড়ে তাহলে তারা সেটাকেই সত্য জ্ঞান করেন। বিভুরঞ্জন ছিলেন বৃহত্তর বাম-আওয়ামী ধর্মের একজন অন্ধবিশ্বাসী সাধক।
যে পরিমাণ দালালী উনি করে গেছেন তাতে উনার জীবন কঠিন হওয়ার কথা ছিলো না। তবু কঠিন হয়েছে কারণ তিনি দালালীটা বাংলাদেশ বিরোধিতার বাম-আওয়ামী ধর্মীয় অনুভূতির জায়গা থেকে করেছেন, কিন্তু সেটাকে টাকা ও সুযোগ সুবিধায় রূপান্তর করার জন্য যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন না। তার কম্যুনিকেশন স্কিল দুর্বল ছিল এবং বাম-আওয়ামী আদর্শিক সত্যের প্রেরণা তাকে তা করতে যথেষ্ট সায় দেয়নি।
আওয়ামীলীগের এরকম বহু কমিটেড লোক আছে যারা দলের জন্য সন্ত্রাস করেছেন, মারামারি করেছেন, আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন, জীবনযৌবন উজাড় করেছেন কিন্তু এসবকে দলীয় পদপদবি ও টাকায় কনভার্ট করতে পারেননি বা করেননি৷ দলীয় আদর্শিক চেতনা থেকে এসব ত্যাগ প্রশংসনীয় কিন্তু দলটা যদি ফ্যাসিস্ট-নিপীড়কদের হয় তাহলে এধরণের আদর্শবাদীদের বরং বেশি ঘৃণা করা প্রয়োজন।
বিভুরঞ্জন সরকারের কমিউনিকেশন স্কিল যে খারাপ ছিল এর প্রমাণ বহন করে তারই লেখা সুইসাইড নোটের এই কথাটি- “শেখ হাসিনার শাসনামলে নানা পরিচয়ে অনেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। একপর্যায়ে লাজলজ্জা ভুলে আমিও শেখ হাসিনার দরবারে সাহায্যের আবেদন করে কোনো ফল পাইনি। অনেক সাংবাদিক প্লট পেয়েছেন। আমি দুইবার আবেদন করেও সফল হইনি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লিখেও নাকি কতজন ভাগ্য বদলেছেন। অথচ আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত দুটি বইয়ের জন্য আমি দুই টাকাও রয়্যালিটি পাইনি।”
এই ধরনের বই লিখে লাখ লাখ টাকা কামানো সম্ভব। অনেকেই কামিয়েছেন। উপায়টা হলো সরকারি লাইব্রেরি ও দপ্তরগুলোকে দিয়ে সরকারিভাবে এসব বাজে বইয়ের হাজার হাজার কপি কেনানো। বিভুরঞ্জন হয়তো ভেবেছেন বই লিখে বসে থাকলেই হবে। এরজন্য দৌড়ঝাঁপ জরুরি। তিনি সম্ভবত সেটা করেননি। আর প্লট পাওয়ার নিয়ম হচ্ছে নেতাদের সাথে উঠাবসা করা, যোগাযোগ রাখা ও সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে সক্রিয় থাকা, নির্বাচন করা ইত্যাদি৷ বিভুরঞ্জন হয়তো ভেবেছেন বিডিনিউজে দালালিমূলক কলাম লিখে বসে থাকলেই হবে। এগুলা অদক্ষতা। নৈতিক সততা নয়।
সাংবাদিকতায় সম্মানজনক বেতন ভাতা না পাওয়ার কারণ হিসেবে উনি দাবি করেছেন সত্যকে গোপন না করা। বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় সম্মানজনক বেতন ভাতার সাথে সত্য অসত্যের সংযোগ ব্যাপক নয়। হ্যা, সাহসী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অনেকেই নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, কিন্তু সবার জন্যই এটা সত্য যে এখানে সাংবাদিকতা পেশায় বেতন ভাতা মোটের উপর সম্মানজনক নয়। এর মাঝেও অনেকে নিজ যোগ্যতায় ভালো টাকা বেতন পান।
যেমন বিভুরঞ্জন আকাংখার সাথে উল্লেখ করেছেন তার বিভাগীয় প্রধানের বেতন তার চেয়ে দ্বিগুণ। উনার মত একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক আওয়ামী আমলে, হাসিনার জন্য দু’টি বই লিখে দালালীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেও যে আওয়ামীলীগের কোন পত্রিকার সম্পাদক, এমনকি অন্তত বিভাগীয় প্রধান হতে পারেন না সেটা তার বাস্তবিক কাজের অদক্ষতার কারণেই। আমাদের বর্ষীয়ান সাংবাদিকদের অনেকেই পলিটিকাল বুলশিট লেখাকে সাংবাদিকতার যোগ্যতা মনে করেন।
৫ আগস্টের পর উনার জীবন কঠিন হয়ে যাওয়ার বাস্তবিক কারণ আছে। যেমন উনি লিখেছেন, “অথচ এখন কোনো কোনো পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে ছাপার জন্য অনুরোধ করেও ফল পাই না। আমার লেখা নাকি পাঠক আর সেভাবে ‘খায়’ না।” আসলেই উনার রাবিশ লেখা পড়ার লোক এখন কেউ নাই। ফলে কলাম লেখা থেকে আয় কমে যাওয়া স্বাভাবিক।
একটা জায়গা খুব গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করতে চাই, উনি লিখেছেন, “মন খুলে সমালোচনা করার কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। কিন্তু তার প্রেস বিভাগ তো মনখোলা নয়। মিডিয়ার যারা নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন তারা সবাই আতঙ্কে থাকেন সব সময়। কখন না কোন খবর বা লেখার জন্য ফোন আসে। তুলে নিতে হয় লেখা বা খবর!”
এটা খুবই নতুন ধরনের অভিযোগ। তাও আবার একজন সাংবাদিকের সুইসাইড নোটে। প্রেস সচিব বারবার জোর দিয়ে বলেছেন উনি কিংবা উনার টিম কোন সংবাদমাধ্যমে কোনদিন খবর নামানোর জন্য ফোন দেননি৷ কোন গণমাধ্যম বা সাংবাদিকও আজ পর্যন্ত এমন দাবি করেননি। সাংবাদিক পাড়ায় এমন কানাঘুষাও শোনা যায়নি। দ্য ঢাকা নামের একটা নিউ মিডিয়ার একটা পোস্ট তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পক্ষ থেকে সরানোর চাপ ছাড়া এপর্যন্ত এরকম কোন অভিযোগ শোনা যায়নি। আশা করি প্রেস সচিব আরও একবার বিষয়টা পরিষ্কার করবেন।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো- উনি লিখেছেন, “সরকার বদলের পর বিভাগীয় প্রধানের কোপানলে পড়ে আমার মেধাবী মেয়েটি থিসিস পরীক্ষায় অসফল হলো।” এই ঘটনা সত্য কিনা তা তদন্ত করে দেখা উচিত। কারো রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে পরীক্ষায় পক্ষপাত করা যেতে পারেনা।
মাজহারুল ইসলাম বাবলার বমনোদ্রেককারী এক লেখা সমর্থন করে তিনি লিখেছেন, “আপত্তিকর কি লিখেছেন বাবলা? লিখেছেন, সেনাবাহিনী শেখ হাসিনাকে সামরিক হেলিকপ্টারে দিল্লি পাঠিয়েছে। আর শুধু পুলিশের গুলিতে নয়, মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে জঙ্গিরাও মানুষ হত্যা করেছে। এখানে অসত্য তথ্য কোথায়?”
এই অংশটির ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন। এই বাক্যগুলো থেকে বিভুরঞ্জন কতটা একনিষ্ঠ অন্ধ ফ্যাসিস্ট ছিলেন তা বুঝতে কারো বাকী থাকার কথা নয়। সুইসাইড নোটেও একজন মানুষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে জঙ্গিদের দ্বারা মানুষ হত্যার ন্যারেটিভকে তুলে ধরলেন!
আমার ধারণা আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলে উনাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হতো না। জোর প্রচেষ্টা চালালে কোন না কোনভাবে হয়তো হাসিনার কৃপা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হতেন।
যাইহোক, আমাদের স্বীকার করতে হবে আওয়ামীলীগের বহু মানুষ আজ বিপদের সম্মুখীন। চুরিচামারির সুযোগ হারানোর পাশাপাশি অনেকেই বৈধ জীবিকার উপায়ও হারিয়েছেন। আমরা এমন একটা দেশ চাইনা যেখানে জাতি বিভক্ত এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে জীবিকা প্রভাবিত হবে। এটা খুবই মৌলিক ব্যাপার। আমাদের রিকনসিলিয়েশনের দিকে যেতে হবে। তারজন্য অবশ্যই যারা অতীতে নানা ভুল ভ্রান্তি অপরাধ করেছেন তাদেরও সেগুলোর দায় স্বীকার করে আন্তরিক ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সংবাদকর্মী (লেখাটি ফেসবুক পাতা থেকে নেয়া)