নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে এখনও সরানো হয়নি আওয়ামীলীগের মদদপুষ্ট ও তোষামোদকারী কর্মকর্তাদের

বিশেষ প্রতিনিধি : ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের এক বছর পার হলেও খোদ নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে এখনও সরানো হয়নি আওয়ামীলীগের মদদপুষ্ট ও তোষামোদকারী কর্মকর্তাদের। বিগত ষোল বছরের বেশিরভাগ সময় এসব কর্মকর্তা আওয়ামীলীদের মন্ত্রী-এমপিদের সাথে যোগাযোগ রেখে আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর ছিলেন। কেউ কেউ আওয়ামীলীগের পার্টি অফিসের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখতেন।
এ তালিকার শীর্ষে রয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপসচিব রাশেদুল ইসলাম ও নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনন্টিটিউটের পরিচালক মোঃ আতিয়ার রহমান। রাশেদুল ইসলাম ২০১৩ সালে কুমিল্লার জেলা নির্বাচন থাকাকালীন সময়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ও তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই সাবেক দুই মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে তিনি কুমিল্লার জেলা নির্বাচন অফিসার থাকাকালীন স্থানীয় সরকার নির্বাচন গুলোতে মন্ত্রীদের পছন্দের প্রার্থীদের পাশ করিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
২০১৭ সালে রাশেদুল ইসলাম নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে উপসচিব হিসেবে যোগদান করে অদ্যাবধি কর্মরত রয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পেলেও তিনি নিচের পদেই কাজ করছেন। নির্বাচন কমিশনের সাবেক বিতর্কিত দুই সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ও জাহাঙ্গীর আলমের ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন তিনি।
নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনন্টিটিউটের পরিচালক মোঃ আতিয়ার রহমান ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন পরিচালনা শাখায় সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি পদোন্নতি পেয়ে নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব হিসেবে আওয়ামীলীগের ফরমায়েশ বাস্তবায়ন করেছেন। আওয়ামীলীগ অফিসের কর্মচারী মোস্তাফিজুর রহমান বাবলা তার সাথে সার্বক্ষণিক সমন্বয় করতেন। বাবলাও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মত নির্বাচন ভবনে নিয়মিত অফিস করতেন।
এরপরেই রয়েছে চট্টগ্রামের সাবেক আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান। ২০২০সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার বিতর্কিত ভূমিকাতো ছিলই, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কারচুপির সকল রেকর্ড ভেঙ্গে তিনি নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছেন। ইভিএমে অনুষ্ঠিত চসিক নির্বাচনে অর্থের বিনিময়ে তিনি ফলাফল পাল্টে দেন। নির্বাচনের দিন ও পরের দিন দেশের সকল প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ফলাও করে অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হলেও তখনকার নুরুল হুদা কমিশন এ বিষয়ে নিশ্চুপ ছিল। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে পুরষ্কারস্বরুপ তাকে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি বিভাগে পরিচালক হিসেবে বদলী করে আনা হয়। বর্তমানে তিনি নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পরিচালকহিসেবে কর্মরত আছেন।
আওয়ামীলীগ আমলের আরেক দোর্দন্ড প্রতাপশালী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত বিনা ভোটের নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গার জেলা নির্বাচন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনে কুমিল্লার এবং ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে ঢাকার জেলা নির্বাচন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আওয়ামীলীগের বিশ্বাসের মুল্য রেখেছেন। ৫আগস্ট ২০২৪ সালের পর তাকে ওএসডি করা হলেও ইসির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আবার তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিশাখার উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন এবং একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ঘনিষ্ট হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন।
আবুল কাশেম মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম আওয়ামীলীগের চরম সুবিধাভোগী ও সহচর। তিনি ২০১১ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদার একান্ত সচিব হিসেবে কাজ শুরু করেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে। এটিএম শামসুল হুদার আত্নীয় পরিচয়দানকারী মাজহারুল ইসলাম ২০১১ হতে ২০২২সাল পর্যন্ত একটানা ৩জন সিইসির একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেন। ২০২২ সালে একান্ত সচিবের পদ হতে সরিয়ে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক করা হয়। অক্টোবর ২০২৫ সালে তাকে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন অফিসার হিসেবে বদলী করা হলেও তিনি সেখানে যোগদান করেরনি। তৎকালীন ইসি সচিব শেখ হাসিনার একান্ত অনুগত শফিউল আজিমের সাথে আওয়ামী কানেকশন কাজে লাগিয়ে সেই অর্ডার বাতিল করান। এরকম একজন বিতর্কিত কর্মকর্তাকে পরবর্তীতে এনআইডি বিভাগের মত স্পর্শকাতর জায়গায় পদায়ন করা হয়েছে।
আরেক বিতর্কিত ও চরম দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আসমা দিলারা জান্নাত। সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নাতনী পরিচয়দানকারী এই নারী কর্মকর্তা সাবেক ইসি ব্রি.জেনা.(অবঃ) মোঃ জাবেদ আলীর একান্ত সচিব হিসেবে কাজ শুরু করেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে ২০১৩ সালে। এরপর ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত একটানা ৪জন নির্বাচন কমিশনারের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন।
আরেকজন সুবিধাবাদী উপসচিব রয়েছেন যার নাম মোঃ শাহ আলম। তিনি এক যুগেরও বেশী সময় আগে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সহকারী সচিব হিসেবে বদলী হয়ে এসে এখন উপসচিব হয়েছেন। প্রতি তিন বছর পর পর বদলীর নিয়ম থাকলেও তার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হয়নি। আওয়ামীলীগ আমলে নিজেকে জাহির করার জন্য তিনি কাঁদো বাঙালী কাঁদো শিরোনামে শেখ মুজিবের রক্তমাখা ছবি ব্যবহার করে নিচে নিজের ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতেন। সালাউদ্দিন আহমদ তিনি ছাত্রজীবনে সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও তিনি প্রায় এক যুগ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে কাজ করছেন। ৫ আগস্টের পর তাকে এনআইডি বিভাগের মত স্পর্শকাতর জায়গায় পদায়ন করে পুরষ্কৃত করা হয়েছে।
আরেক আওয়ামী সুবিধাবাদী সহিদ আব্দুস সালাম। তার মামা শ্বশুর সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ও পিএসসি এর সাবেক সদস্য ফয়েজ আহমেদের প্রভাব খাটিয়ে তিনিও এক যুগের মত নির্বাচনী প্রশিক্ষন ইনস্টিটিউট ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে চাকুরী করছেন। তিনি চাকুরীর পাশাপাশি ইটিইসহ সারা দেশের নির্বাচন অফিসগুলোতে ট্রেনিং সামগ্রী সরবরাহের ব্যবসা করেন। আরেক ছাত্রলীগ নেতা মোঃ মিজানুর রহমান ২০১১ সাল থেকে নির্বাচন প্রশাসন শাখায় কাজ করছেন। তবে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই কিন্তু অফিসিয়াল সিক্রেসি ফাঁস ও আওয়ালীগারদের সুবিধা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। শরিফুল আলম পরিচালক জনসংযোগ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তথ্য ক্যাডারের এই কর্মকর্তাকে ২০২৪ সালের আগে ইসিতে বদলী করা হয়। তিনি মূলত আওয়ামীলীগের সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত। তাকে এখনও নির্বাচন কমিশন হতে সরানো হয়নি।
সাবেক প্রধান নির্বাচ কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের একান্ত সচিব রিয়াজ উদ্দিনকে তার পদ হতে সরিয়ে নির্বাচনী প্রশিক্ষন ইনস্টিটিউটে বদলী করা হয়েছে কিন্তু ঢাকা হতে সরানো হয়নি। আশংকা করা হচ্চে এসব বিতর্কিত কর্মকর্তারা যেসব পদে এখন আছেন সেই অবস্থায় নির্বাচনের তফসীল ঘোষনা করা হলে তারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে উঠবেন। এই মুহুর্তে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করার কাজে তাদেরকে ব্যবহার করা হতে পারে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়েও ২০১৮ ও ২০২৪ সালে জেলা নির্বাচন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকরী আওয়ামীলীগকে সুবিধা দেওযা সকল জেলা নির্বাচন অফিসার এখনও তাদের স্বপদে বহাল রয়েছে।প্রশাসন ও পুলিশের এ দুটি নির্বাচনে দায়িত্বপালনকারী প্রায় সকল ডিসি, এসপিদের প্রত্যাহার করা হলেও জেলা নির্বাচন অফিসার বহাল থাকায় জনমনে আশংকা দেখা দিতেই পারে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কারন তারাই মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের সরাসরি প্রতিনিধি।