আমদানিকারকদের জন্য যত সুবিধা: দেশিয় কসমেটিকস উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে
বাজেট প্রতিক্রিয়া

মুক্তমন রিপোর্ট : অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার খাতে আমদানি উৎসাহিত করা হয়েছে ।যত সুবিধা সব দেয়া হয়েছে আমদানিকারকদের। ফলে দেশিয় কসমেটিকস উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানিকৃত কসমেটিকস পণ্যের প্যাকেজিং শুল্ক মুক্ত হলেও দেশীয় উৎপাদনের কাচামাল হিসেবে প্যাকেজিং আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ১২৮ শতাংশের মত। যা বৈষম্যমূলক। এমনকি সরাসরি কসমেটিকস আমদানির ক্ষেত্রে কেউ সোনা মুড়িয়ে প্যাকেজিং করে, তা দেশে নিয়ে আসে, কিছুই করার থাকে না।
আমদানিকৃত পণ্যের ট্যারিফ ভ্যালু এতই কম যে তা বৈষম্যমূলক । কসমেটিকস পণ্যের ট্যারিফ ভ্যালু আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শুল্কায়েনের দাবি করেছেন উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, আমদানি পর্যায়ে প্রকৃত ক্রয় মূল্য গোপন করে ন্যূনতম ট্যারিফ মূল্যে শুল্কায়নের ফলে আমদানিকৃত কালার কসমেটিকস পণ্য সামগ্রীর ল্যান্ডেড কষ্ট স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত কালার কসমেটিকস পণ্যের উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম হয়। যে কারনে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কালার কসমেটিকস ও আমদানিকৃত কালার কসমেটিকস পণ্যের মধ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অনুপস্থিত। তাই কালার কসমেটিকস পণ্য সামগ্রীর ন্যূনতম ট্যারিফ মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে সাথে সামঞ্জস্য রেখে নেট ওয়েট এর পরিবর্তে গ্রস ওয়েট বিবেচনায় নিয়ে কাস্টমস শুল্কায়ন করা আবশ্যক বলে দাবি করেছেন তারা।
কালার কসমেটিকস পণ্য দেশে আমদানি পর্যায়ে শুল্কায়েনের ক্ষেত্রে যে নীতি প্রচলিত রয়েছে তা দেশীয় উৎপাদন ও শিল্প বিকাশে অন্যতম বাধা বলে মনে করছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা। এ খাতের বাণিজ্য সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশের (এএসবিএমইবি) এর নেতৃবৃন্দ সরকারের কাছে ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। এএসবিএমইবি নেতৃবৃন্দ বলছেন, এ খাতে যথাযথ নীতি সহায়তা পেলে বিনিয়োগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হবে।
অর্থ উপদেষ্টার প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ২০২৫-২০২৬ এ জারীকৃত কাস্টমস এস.আর.ও. নং ২২৬-আইন/২০২৫/৪৮, অনুসারে প্রতি কেজি (নেট ওয়েট) কালার কসমেটিকস পণ্য সামগ্রী কাস্টমস শুল্কায়ন করা যায় ন্যূনতম ট্যারিফ মূল্যে; ৪০ ডলার থেকে শুরু করে ১০ ডলার পর্যন্ত। উদাহরণ হিসেবে লিপস্টিক (এইচএস কোড ৩৩০৪.১০.০০) নেটওয়েট প্রতি কেজি ক্রয় মূল্য ৪০ ডলার বিবেচনায় নিয়ে শুল্কায়ন করা হয়। প্রতি পিস লিপস্টিকের গড় নেটওয়েট যদি ৪.০০ গ্রাম হয় তাহলে প্রতি কেজিতে লিপস্টিকের সংখ্যা হয় ২৫০ পিস, সে হিসেবে ন্যূনতম ট্যারিফ ভ্যালু অনুযায়ী প্রতি পিসের মূল্য দাঁড়ায় শুন্য দশমিক ১৬ ডলার বা ২০ টাকা। এই মূল্যে আমদানিকৃত প্রতি পিস লিপস্টিকের বিপরীতে সরকার কাস্টমস ডিউটি পেয়ে থাকে মাত্র ৩১ দশমিক ৪৬ টাকা। ক্রয় মূল্য ও কাস্টমস ডিউটি সহ প্রতি পিস আমদানিকৃত লিপস্টিকের ল্যান্ডেড কস্ট দাড়ায় মাত্র ৫১ দশমিক ৪৬ টাকা। অথচ দেশের বাজারে কাস্টমারের কাছে আমদানিকৃত ঐ সকল লিপস্টিক বিক্রয় হয় ন্যূনতম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। এই হিসাব থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সরকার আমদানিকৃত কালার কসমেটিকস থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে মোটামুটি গুনগতমান সম্পন্ন প্রতি পিস লিপস্টিকের প্রকৃত ক্রয় মূল্য ন্যুনতম ১ ডলার থেকে শুরু করে ১০ ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। অথচ বাংলাদেশে যে কোন মানের লিপস্টিক কাস্টমস এস.আর.ও. নং ২২৬-আইন/২০২৫/৪৮ অনুসারে প্রতি কেজি (নেট ওয়েট) ২০ ডলারে শুল্কায়ন করা সম্ভব। প্রস্তাবিত বাজেটে তা ৪০ ডলার করা হলেও আন্তর্জাতিক বাজারের নূন্যতম মূল্যের সাথে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে স্থাপিত নতুন কালার কসমেটিকস শিল্প বিকাশের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে কালার কসমেটিকস পণ্য সামগ্রী আমদানি পর্যায়ে নূন্যতম শুল্কায়ন। যেহেতু ঐ সকল পণ্যের শুল্কায়ন নেট ওয়েট বিবেচনায় নিয়ে করা হয় তাই পণ্যের ধারক বা মোড়ক এর মূল্য এবং ওজন শুল্কায়ন করার সময় বিবেচনা করা হয় না। অথচ যখন কোন স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ঐ সকল পণ্যের ধারক/কনটেইনার উপকরণ হিসেবে আমদানি করলে এইচএস কোড ৩৯২৩.১০.০০ অনুসারে ১২৭ দশমিক ৭২ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি প্রদান করতে হয়। কাস্টমস শুল্কায়ন এ এই দ্বৈত নীতি দেশীয় শিল্প বিকাশে অন্যতম প্রতিবন্ধক।
তারা বলেন, পণ্যের সঙ্গে একক ও অভিন্ন সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে কসমেটিকস পণ্যের কনটেইনার শুল্কায়ন হয় এবং তা পণ্যের অংশ হিসেবেই ভোক্তার কাছে বিক্রি হয়। এসব পণ্য ধারক বা কনটেইনারের ওজনভিক্তিক মূল্য প্রধান আমদানি পণ্যের সঙ্গে যুক্ত করে মূল পণ্য শুল্কায়ন মূল্য নিরূপন করতে হবে।
এএসবিএমইবি’র সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দীন বলেন, ব্ষ্যৈম্যমূলক নীতির কারনেই মুলত: দেশে এতদিন কসমেটিকস ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠেনি। সম্ভাবনাময় এই ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠলে একদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে অপরদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হবে। তাছাড়া দেশে উৎপাদন বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার অবচয় রোধ করে বিদেশে রফতানির মাধ্যমে দেশীয় অর্থনীতির চাকা আরো জোরদার করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে দেশে উৎপাদিত আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কসমেটিকস পণ্য মধ্যপ্রাচ্য, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমদানির বিকল্প ও বৈদেশিক মূদ্রা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা জরুরী। বিদ্যমান বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করলে এই খাতে বিনিয়োগ করতে দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন। যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।