আইন-অপরাধ

সাংবাদিক তুহিন হত্যায় ১৫ দিনের মধ্যে চার্জশিট : জিএমপি কমিশনার

মুক্তমন ডেস্ক : গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যার ঘটনায় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়া গেলে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগ পত্র) দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি) কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান।

এ সময় তিনি, যথার্থ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারার কারণে তুহিন হত্যায় ব্যর্থতা নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন ও তিনি নিহত সাংবাদিকের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।

শনিবার (৯ আগস্ট) দুপুরে গাজীপুর মহানগরীর ওয়্যারলেস গেট এলাকায় জিএমপির সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জিএমপি কমিশনার এসব বলেন।

ড. নাজমুল করিম খান বলেন, সাংবাদিক হত্যার দায় আমরা এড়াতে পারি না৷ আমাদের ব্যর্থতা ও জনবল স্বল্পতা রয়েছে। পুলিশের একার পক্ষে অপরাধ দমন করা সম্ভব হয় না। এখানে জনগণের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। এ সময় তিনি অপরাধ দমনে তিনি পুলিশকে সহযোগিতার অনুরোধ জানান।

জিএমপি কমিশনার বলেন, সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের ওপর ছিল। আমরা প্রিভেন্ট করতে পারিনি। প্রিভেনশন সব সময় করা যায় না। বিশ্বের কোনো দেশ ক্রাইম একেবারে শূন্যতে নিয়ে আসতে পারেনি। তাই, আমাদের শত চেষ্টার পরেও ক্রাইম হয়ে যেতে পারে। যে ঘটনাটি ঘটেছে, তার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।

পুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ঘটনার দিন এই ঘটনার প্রথম ভিকটিম বাদশা মিয়া স্থানীয় একটি এটিএম বুথ থেকে ২৫ হাজার টাকা তোলেন। বিষয়টি দেখে তাকে ফাঁসানোর জন্য গোলাপি বাদশাকে হানি ট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করেন। গোলাপির সঙ্গে কথাবার্তার এক পর্যায়ে বাদশা মিয়া বিষয়টি বুঝতে পারেন, যে তাকে হানি ট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তারপর কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং বাদশা মিয়া গোলাপিকে ঘুসি মারেন। সিসিটিভি ফুটেজে বিষয়টি দেখা যায়।

পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, গোলাপিকে ঘুসি মারার পরপরই আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা গোলাপির সহযোগীরা ৫-৬ জন এগিয়ে এসে চাপাতি দিয়ে বাদশা মিয়াকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। তখন বাদশা মিয়া সেখান থেকে পালিয়ে যাবার সময় এই ঘটনার ভিডিও ধারণ করছিলেন নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন। সাংবাদিক তুহিনের ভিডিও ধারণ করার বিষয়টি আসামিরা দেখে ফেলে। তখন তারা বুঝে যায় যে, এই ভিডিওর মাধ্যমে তাদের অপরাধ মানুষের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়বে।

তিনি বলেন, তারপরে আসামিরা সাংবাদিক তুহিনের ভিডিওটি কেড়ে নেওয়ার জন্য তার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ায় এবং তাকে ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে সাংবাদিক তুহিন একটি চা স্টলে আশ্রয় নিলে তাকে সেখান থেকে ধরে এনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

কমিশনার আরও বলেন, ঘটনার পর পরই আমরা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করি। ফুটেজ দেখে আমরা আটজনকে চিহ্নিত করেছি। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জড়িত সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছি৷ বাকি একজনকেও দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে পারব৷

জিএমপি কমিশনার বলেন, সাংবাদিক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন, জামালপুরের মেলান্দহ থানার মাহমুদপুর এলাকার মোবারকের ছেলে মিজান ওরফে কেটু মিজান (৩৫), তার স্ত্রী গোলাপী (২৫), পাবনার ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে মো. স্বাধীন (২৮), খুলনার সোনাডাঙ্গা উপজেলার ময়লাপোতার হানিফের ছেলে আল আমিন (২১), কুমিল্লার হোমনা থানার আন্তপুর গ্রামের হানিফ ভূঁইয়ার ছেলে শাহজালাল (৩২), পাবনার চাটমোহর থানার পাঁচবাড়ীয়া গ্রামের কিয়ামুদ্দিনের ছেলে মো. ফয়সাল হাসান (২৩) এবং সুমন নামের একজন।

তিনি আরেও বলেন, হত্যার প্রধান আসামি কেটু মিজানের নামে ১৫টি মামলা রয়েছে। কেটু মিজানের স্ত্রী পারুল আক্তার ওরফে গোলাপি, যিনি হানি ট্র্যাপ কার্যক্রমে জড়িত। অপর আসামি আল আমিনের ২টি মামলা, স্বাধীনের নামে ২টি মামলা, শাহজালালের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা, ফয়সাল হাসানের বিরুদ্ধে ২টি মামলা রয়েছে।

তিনি বলেন, সংঘবদ্ধ চক্রের অপরাধের চিত্র ধারণ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন সাংবাদিক। এ ঘটনায় আমাদের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ আছে, প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষী আছেন। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। তুহিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রাপ্তী সাপেক্ষে আমরা আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই আদালতে চার্জশিট দিতে পারব। আমরা আশা করি দ্রুত তাদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সাজার সংস্কৃতি নিশ্চিত করা গেলে ক্রাইম দমন করা যাবে। আসামিরা যদি নাও স্বীকার তবে, এভিডেন্সই তাদের অপরাধ প্রমাণ করবে।

পুলিশের এই কর্মকর্তা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, পুলিশ এখনো তাদের মনোবল ফিরে পায়নি। এ জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। গাজীপুরে ৫ আগস্টের পর অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেলে ক্রাইম বেড়ে যায়। এটা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি। এ ছাড়া আগের রেজিম এই জেলায় শক্তিশালী। সেই দলটি চায় না গাজীপুর স্থিতিশিল হোক। তারা গাজীপুরকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। সেটিও নজরদারি করা হচ্ছে। এই নজরদারি করতে গিয়ে অন্যান্য অপরাধে মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। তবে, মানুষের স্বস্তি ফেরাতে কাজ করছে জিএমপি।

প্রসঙ্গত, গাজীপুর মহানগরীর ব্যস্ততম চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বৃহস্পতিবার রাত ৮টা দিকে একটি মার্কেটের ভেতরে প্রকাশ্যে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন (৩৮) দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া গ্রামের হাসান জামালের ছেলে তিনি। তিনি স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন।

জিএমপির বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্কমর্তা (ওসি) শাহীন খান বলেন, সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় বাসন থানায় দুটি মামলা হয়েছে। এর একটি মামলার বাদী হয়েছেন নিহত সাংবাদিক তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম। অপর একটি মামলার বাদী, তুহিন হত্যার আগে সংগঠিত আরেকটি হামলার ঘটনায় আহত বাদশা মিয়ার ভাই। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।

নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত শুক্রবার সকালে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সম্পন্ন হয়। পরে শুক্রবার জুমার নামাজের পর গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার যেখানে তাকে হত্যা করা হয়, সেখানেই ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরে ময়মনসিংহে তার গ্রামের বাড়ীতে দাফন সম্পন্ন হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button