একাত্তর ইস্যুতে ঝুলে গেল বাংলাদেশ-পাকিস্তান কুটনৈতিক সমঝোতা

কূটনৈতিক প্রতিনিধি : রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে পাকিস্তান। আর বাংলাদেশের চাওয়া অতীত থেকে বের হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। তবে অমীমাংসিত তিন সমস্যা, বিশেষ করে একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমার প্রশ্নে আটকা পড়ছে ইসলামাবাদ। দেশটি একাত্তরসহ অমীমাংসিত তিন সমস্যার সমাধানে কোনো নিশ্চয়তা না দিলেও আগামী দিনে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে।
একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা, প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পাওনা পরিশোধ এবং আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরানোর অমীমাংসিত বিষয়গুলো ঝুলে আছে বহু বছর ধরে। বিগত সরকারের শুরুর শাসনামলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলেও শেষ সময়ে নানা কারণে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তবে তাদের কূটনৈতিক চ্যানেলে অমীমাংসিত তিন সমস্যার কথা বারবার তুলতে দেখা গেছে। কিন্তু সমাধান আসেনি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ বাড়ায় পাকিস্তান। দিনে দিনে ইসলামাবাদ ঢাকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। সেই চেষ্টা কাজেও আসে। ইতোমধ্যে বিদেশের মাটিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের মধ্যে নিউইয়র্ক ও মিসরে সাক্ষাৎ হয়েছে। আর ঢাকা সফররত পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের বিদেশের মাটিতে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে চারবার দেখা হয়, আলাপ হয়।
এরই মধ্যে গত এপ্রিলে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পথ খোলে। সেসময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ ঢাকা সফর করেন। আলোচনা করেন সম্পর্কের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে। ওই মাসের শেষের দিকে ঢাকায় আসার কথা ছিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। কিন্তু ভারতের পেহেলগ্রামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় দারের সফর স্থগিত হয়ে যায়।
সেই স্থগিত সফরে শনিবার (২৩ আগস্ট) দুই দিনের জন্য ঢাকায় আসেন ইসহাক দার। এক যুগ পর ঢাকায় আসা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে রাজনৈতিক স্তরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্ব পেতে দেখা গেছে। তবে আগামী দিনে ঢাকা-ইসলামাবাদের সম্পর্ক কেমন হবে, সেটা বোঝার জন্য তৌহিদ-দারের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
রোববার (২৪ আগস্ট) নির্ধারিত সময়ে রাজধানীর একটি হোটেলে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন তারা। প্রথমে একান্তে ও পরে প্রতিনিধি পর্যায়ে চলে বৈঠক, এরপর দুই দেশের মধ্যে সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা বিলোপ চুক্তি এবং পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের আনুষ্ঠানিকতা দেখেন দুই মন্ত্রী।
এরপর রুম থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে পড়েন ঢাকা সফররত ইসহাক দার। শুরুতেই একাত্তরের ক্ষমার প্রসঙ্গ। তবে হাইপ্রোফাইল দার শুরুতে সম্পর্কের কমফোর্ট জোন নিয়ে কথা বলেন। এরপর সুবিধামতো বলতে থাকেন একাত্তর প্রসঙ্গ।
ইসহাক দার বলেন, ‘দেখুন, প্রিয় ভাই, ১৯৭৪ সালে ইস্যুটি লিখিতভাবে সমাধান হয়েছে। এই ডকুমেন্টটি ঐতিহাসিক এবং দুই দেশের কাছেই আছে। আর তারপর যখন জেনারেল মোশাররফ এখানে এসেছিলেন; খুব খোলামেলা ও অকপটে তিনি এই ইস্যুটি তুলে ধরেছিলেন। আমি মনে করি পরিবারের মধ্যে, দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো কিছুর একবার সমাধান হলে, সেটা হয়ে গেছে।’
এদিকে, তৌহিদ-দারের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক নিয়ে রোববার দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন ছিল। নির্ধারিত সময়ের কিছুটা পরে ব্রিফ করতে আসেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। বৈঠক নিয়ে হাতে থাকা নোট থেকে প্রায় সাত মিনিট কথা বলেন তিনি। এরপর আসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের প্রসঙ্গ। শুরুতে একাত্তর নিয়ে দারের মন্তব্যের ব্যাপারে ঢাকার অবস্থান জানতে চাওয়া হয়।
জবাবে তৌহিদ হোসেন সাফ জানিয়ে দেন ইসহাক দারের বক্তব্যের সঙ্গে তিনি একমত নন। তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি অবশ্যই একমত না। একমত হলে তো সমস্যাটা সমাধান হয়ে যেত তাদের মতো করে, তাই না? আমি তো বললাম আপনাকে যে, আমরা আমাদের অবস্থানটা বলেছি, উনারা উনাদের অবস্থানটা বলেছেন।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা চাই যে হিসাবপত্র হোক এবং টাকা-পয়সার বিষয়টি সমাধান হোক। আমরা চাই এখানে যে গণহত্যা হয়েছে, সেটির বিষয়ে তারা দুঃখ প্রকাশ করুক, মাফ চাক। আমরা চাই আটকে পড়া মানুষগুলোকে তারা ফেরত নিয়ে যাক।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তিনটি বিষয়ে আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছি। দুই পক্ষই আমরা ঠিক করেছি এই বিষয়গুলো আমাদের সমাধান করতে হবে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মসৃণভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এগুলোকে পেছনে ফেলতে হবে। আমরা দুই পক্ষ সম্মত হয়েছি যে, এটি নিয়ে আমরা কথা বলব এবং চেষ্টা করব এই ইস্যুগুলো নিয়ে আগামীতে এমনভাবে কথা বলব যেন আমরা পেছনে ফেলতে পারি।’
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর মনে করেন, ‘এই সফরের দুটি দিক আছে। অতীতমুখী বা অতীতের বিষয় নিয়ে যদি বলি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার দায় পাকিস্তানের আছে। তারা বলছে, দুইবার বলেছে। দুইবার বললে, তৃতীয়বার বলতে আপত্তি কী? পাকিস্তান তো স্বীকার করছে, এখানে কিছু একটা হয়েছে; সেজন্য তাদের ভাষায়, দুইবার তাদের বলতে হয়েছে। তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে হবে।’
‘কারণ, এটা আমাদের আত্মার সঙ্গে সম্পৃক্ত। লাখ লাখ মানুষের প্রাণ গেছে এ দেশে। কাজেই সে জায়গায় পাকিস্তানের দিক থেকে উনি (উপপ্রধানমন্ত্রী) খোলা মনে বলেছেন, উনাদের দিক থেকে মনটা খোলা হওয়া দরকার এবং খোলা মনে তাদের অপরাধের দায়টা স্বীকার করা দরকার। এটা আমরা বলব এবং সেটা আমাদের অতীতকে বর্তমানের কাছে নিয়ে আসার জন্য সুযোগ তৈরি করবে,’ যোগ করেন হুমায়ুন কবির।
১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হাতে ৩০ লাখ মানুষ নিহত এবং ৩ লাখ নারী ধর্ষিত হয়। এ ঘটনায় পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবে অর্ধশতক পার হয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চায়নি পাকিস্তান। শুধু ২০০২ সালে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশ সফরে এসে ওই ভূমিকার জন্য সাধারণভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।
গত এপ্রিলে ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানকে।
ইসহাক দারের সফরে রাজনৈতিক স্তরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব পেতে দেখা গেছে। সফরের শুরুর দিনে তিনি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ছাড়া আজ (রোববার) দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ, বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রাজনৈতিক যোগাযোগের প্রশ্নে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীরের ভাষ্য, তারা যেহেতু আসছে যোগাযোগ করবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তি যারা আছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, এটা নিয়ে আমি চিন্তার কিছু দেখছি না। এটা স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া, তারা করছে। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এটা যেন ভারসাম্যের মধ্যে থাকে। এটা যেন দেশের জন্য উপাদেয় হয় এবং জাতীয় স্বার্থের আলোকে।
তিনি বলেন, দুই দেশ আমরা একই অঞ্চলের। পারস্পরিকতা আছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ আছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও সহযোগিতার সুযোগ আছে। আমরা সেগুলো কাজে লাগানোর জন্য সচেষ্ট থাকব। কাজেই এখানে তাদের উপপ্রধানমন্ত্রীর সফরে সেই সুযোগটা তৈরি হয়েছে। আমরা চেষ্টা করব, আমাদের জাতীয় স্বার্থকে মনে রেখে দ্বিপাক্ষিকভাবে একটা উপাদেয় রেখে সামনের দিকে যাওয়া যায়।
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রোববার রাতেই ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে ইসহাক দারের।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ডি-৮ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকায় এসেছিলেন। এর দীর্ঘ ১৩ বছর পর ঢাকায় এলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।