মত প্রকাশ

চির বিদায়ের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে ইতিহাসের এক গর্ব

ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল ফারুক

একটি বিদায়, যা ইতিহাসের পাতায় রক্তের অক্ষরে লেখা হওয়া উচিত ছিল…আমি ছিলাম তার পাইলট, আজ আমি শুধু তার স্মৃতির পাহারাদার।”
এই McDonnell Douglas DC-10-30 একসময় আকাশ ছুঁয়েছিল গর্বে, গর্জনে। এটি শুধু একটি বিমান নয়—এটি ছিল বাংলাদেশের আকাশযাত্রার প্রতীক, Biman Bangladesh Airlines-এর আন্তর্জাতিক স্বপ্নের বাহক। JFK থেকে Heathrow, Frankfurt থেকে Jeddah—এই ধাতব পাখি বহন করেছে হাজারো প্রবাসীর চোখের জল, মায়ের দোয়া, সন্তানের অপেক্ষা।
এটি গিয়েছে আমেরিকার মাটি ছুঁয়ে, ইউরোপের আকাশে গর্জন করে। কিন্তু আজ, যখন তার ইঞ্জিন নীরব, তার ডানা স্থির, তখন কোনো মিউজিয়াম তাকে আশ্রয় দেয়নি। কোনো ঐতিহাসিক সংরক্ষণ তাকে ঠাঁই দেয়নি।
এখন সে নিলামে বিক্রি হয়েছে—তার শরীর কেটে কেটে বিক্রি হবে স্ক্র্যাপ হিসেবে। তার ককপিট, যেখানে একসময় পাইলটের নিখুঁত হাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো, যেখানে প্রতিটি বোতাম, প্রতিটি আলো, প্রতিটি সিদ্ধান্তে ছিল অভিজ্ঞতার ছাপ, সেই ককপিট হয়তো আজ পড়ে থাকবে কোনো গ্যারেজের কোণে, নিঃশব্দে। আর তার কেবিন, যেখানে শত শত যাত্রী ভাগাভাগি করেছে হাসি, কান্না, প্রার্থনা—সেই জায়গায় আজ নেই কোনো আলো, নেই কোনো ঘোষণা, নেই কোনো গন্তব্য। আছে শুধু স্মৃতির ছায়া, আর আমার হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা এক অপূর্ণ ইতিহাস।
এটি ছিল আমার সহচর, আমার আকাশযাত্রার সাথী। আমি ছিলাম এর পাইলট, আমার হাতের স্পর্শে এর ককপিট জীবন্ত হতো, আমার চোখের দৃষ্টিতে এর গতি নির্ধারিত হতো। Brussels, Rome, Paris, Heathrow,Frankfurt থেকে Dhaka সহ বিভিন্ন ফ্লাইটে ছিল আমার নিঃশ্বাস, আমার দায়িত্ব, আমার ভালোবাসা।
ককপিটের প্রতিটি সুইচ, প্রতিটি গ্লাস, প্রতিটি শব্দ আমার চেনা। সেখানে আমি একা ছিলাম না—ছিল যাত্রীদের বিশ্বাস, দেশের সম্মান, এবং আমার নিজের আত্মা। সেই ককপিটে আমি দেখেছি সূর্যোদয়, বজ্রপাত, নিঃশব্দ রাতের আকাশ। দেখেছি আকাশ থেকে খসে পড়ছে উল্কাপিন্ড বা Falling star।
আমি শুনেছি ATC-এর কণ্ঠ, অনুভব করেছি turbulence-এর ধাক্কা, আর নিয়েছি হাজারো প্রাণের দায়িত্ব।
“সরকার চাইলে এটি হতে পারতো একটি জাতীয় গৌরবের প্রতীক—আজ তা শুধুই নিঃশব্দ।”
“আমি দ্বারস্থ হয়েছিলাম—বহু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কাছে। অনুরোধ করেছিলাম, যেন আমার প্রিয় DC-10 ফ্লাইটটিকে নিলামে বিক্রি না করে একটি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়। এটি শুধু একটি বিমান নয়, এটি ছিল একটি ইতিহাস, একটি গর্বের প্রতীক। কিন্তু কেউই রাজি হয়নি। আজ সেই ফ্লাইট কেটে ফেলা হয়েছে, বিক্রি হয়েছে স্ক্র্যাপ হিসেবে। আমরা হারিয়েছি একটি সম্ভাবনা, একটি জাতীয় স্মৃতি।
কখনো কখনো মাটি থেকে ১২ কিলোমিটার উচ্চতা বা ৪০ হাজার ফিটে উড়ে চলার সময় পাশ দিয়ে চলে যেত আর একটি উড়োজাহাজ।
মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে কথা হতো আর সেটার ফ্রিকোয়েন্সি ছিল 123.45 Mhz.
123.45 MHz: Often used informally for air-to-air chat between pilots (especially in remote areas or oceanic flights).

লেখক : বৈমানিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button