
আমাদের দেশে দল যত-মত তত, মত যত-বিরোধ তত। রাজনৈতিক দল, স্বার্থগোষ্ঠী, পেশাজীবী গোষ্ঠী সবাই যে যার অবস্থানকে সত্য নিরপেক্ষ বলে দাবি করে। কিন্তু তাদের এই ঘূর্ণায়মান চাকার নিচে বেশি পিষ্ট হতে হয় সেই মানুষগুলোকে, যারা কোনো চাকা ঘোরাতে চায় না, বাঁচতে চায়, শুধু স্বাভাবিক জীবন চায়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো: কেন সাধারণ মানুষকেই এই ঘানি টানতে হয়? কেন মত–দ্বিমতের দায় তাদের বইতে বাধ্য করা হয়?
বাংলাদেশে রাজনীতির চরিত্র এমন- ব্যক্তিগত মতামতকে সম্মান করার কোন সুযোগ নেই। সাধারণ মানুষের চাওয়া- নিরাপত্তা, কাজ, শান্তি, মৌলিক ন্যায্য অধিকার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া- ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ, নিজেদের আধিপত্য অবস্থান শক্ত করা।
যেখানে দুই পক্ষের বিরোধ, সেখানেই তারা জনতাকে টানতে ব্যস্ত নিজেদের দিকে। চুপ থাকলেও দোষ, কিছু বললেতো আরো দোষ।
গণতন্ত্রে মত থাকা স্বাভাবিক; কিন্তু যখন ভিন্নমতকে শত্রুতা হিসেবে দেখা শুরু হয়, তখন সমাজে দ্বন্দ্বই স্বাভাবিক নিয়মে পরিনত হয়। এই পরিস্থিতিতে জন্ম নেয়- পরস্পর শত্রুতা-প্রতিহিংসা, পরিবার-সমাজে বিভাজন, পেশায় চাপ আর সামাজিক অস্থিরতা। এসবের ভুক্তভোগী কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই মানুষগুলো, যারা আসলে কোনো পক্ষ চায় না, শুধু স্বাভাবিক পরিবেশ চায়। সমস্যা হলো- দুপক্ষই আবার এই সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে সে আমাদের সাথে নয়, সে আমাদের বিরুদ্ধে। তাই এই দুর্বৃত্ত যুক্তির বোঝাও চাপে সাধারণ মানুষের কাঁধেই।
বিরোধী পক্ষগুলো মনে করে মানুষ তাদের পক্ষে কথা বলছে না মানে তারা নিরপেক্ষ নয়। তাদের আরও চাপ দিয়ে তাদের দিকে নিতে হবে। ফলে সাধারণ মানুষের নীরবতা পরিণত হয় চাপের কারণ হিসেবে। এই নীরবতা কখনও হয় ভয় থেকে; কখনও ক্লান্তি থেকে; কখনও অনাস্থা থেকে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা সাধারণ মানুষকে সব সময় এই ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়। বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এগুলো যদি পুরো নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী না হয়, তাহলে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বলি সাধারণ মানুষ হতেই থাকবে। যেখানে আইনের শাসনের চেয়ে দলের শাসন বেশি প্রভাবশালী, সেখানে নাগরিকরা সবসময়ই আতঙ্কে থাকে। রাষ্ট্রের এই দুর্বলতা মত–দ্বিমতের বিরোধকে আরো উস্কে দেয়। আর সমাজ দেশ হয়ে পড়ে ভারসাম্যহীন।
সবচেয়ে নির্মম সত্য- যাদের কাজ হওয়ার কথা- সঠিক তথ্য দেওয়া, সত্য তুলে ধরা, মানুষের মত তৈরি করতে সহায়তা করা। সেই সাংবাদিকতা, সুশীল বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর বড় অংশই আমাদের দেশে নিরপেক্ষ থাকে না বা থাকতে পারে না। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে তৈরি হয় বিভ্রান্তি, আর বিভ্রান্তি যত বাড়ে, সাধারণ মানুষ তত ভোগে সিদ্ধান্তহীনতায়। আর সিদ্ধান্তহীন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে সহজ, এটা রাজনীতিবিদরা ভাল করেই জানে।
যে সমাজে, যে দেশে নিরপেক্ষ থাকা বিপজ্জনক, মত প্রকাশ ঝুঁকিপূর্ণ, ভিন্নমতকে সম্মান সংস্কৃতির অংশ নয়, সেখানে সাধারণ মানুষ নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্যই এক সময় কোনো না কোনো পক্ষ নিতে বাধ্য হয়। মানে সে রাজনীতি বুঝতে-জানতে না চাইলেও রাজনীতি তাকে ছাড়ে না।
মত–দ্বিমত গণতন্ত্রের শক্তি, কিন্তু যখন তা শত্রুতায় পরিণত হয়, তখন অসহায় ও নিরুপায় মানুষগুলোই হয় তার প্রথম শিকার। সাধারণ মানুষের এই দুর্ভোগের কারণ কোনো একক দল নয়- এটি একটি কাঠামোগত সংকটের আস্থাহীনতার বাস্তবতা। কিন্তু এই ঘানি টানতে হয় সাধারণ মানুষকেই। কারণ মত–দ্বিমত নিয়ন্ত্রণের এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই সাধারণ মানুষকে মুক্ত রাখার মানসিকতা রাখে না।



