আমরা যেটাকে গণতান্ত্রিক আওয়াজ বলছি- সেটা মূলত কেওয়াজ।

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসাইন :আমি চীন থেকে ঘুরে আসার পর, আমার মনোজগতে একটা বড় পরিবর্তনের ধাক্কা লেগেছে। এরপর কাতার সফরে সেটা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। রাজনীতি চর্চার নামে এই দেশে যা হচ্ছে কিংবা আমরা যেটাকে গণতান্ত্রিক আওয়াজ বলছি- সেটা মূলত কেওয়াজ।
আমি যখন চীনের বোয়াও শহরে প্রবেশ করি, ভেতরে এক ভীন্ন অনুভূতির টের পাই। মনটা ভীষণ শান্ত হয়ে যায়। এতো ছোট্ট একটি শহর। কিন্তু সাজানো গোছানো- দেখে যে কারো নজর কাড়বে। রাস্তাগুলো এতো পরিচ্ছন্ন, আহ। সবচেয়ে ভালো সেখানকার মানুষগুলো। কতটা মার্জিত এবং ভদ্র, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেন শহর নয়, কেউ আমার মনের ভেতরে ঝাঁট বুলিয়ে দিল। পরিচ্ছন্ন রাস্তা, গোছানো গলি, আর অতল শ্রদ্ধায় ভরা মানুষজন। যেন সভ্যতা এখানে নিঃশব্দে হাঁটে। পরিচ্ছন্নতা এত নিখুঁত যে মনে হয়, এখানকার ধুলোবালিও শৃঙ্খলার পাঠ নেয়। হাইনান প্রদেশের বুক চিরে দক্ষিণ চীন সাগরের জলে ভেসে থাকা দ্বীপ এই বোয়াও, আমাদের দেশের তুলনায় হয়তো কুড়িগ্রামের মতো প্রত্যন্ত, কিংবা সেন্ট মার্টিনের মতো পর্যটননির্ভর। অথচ এমন দুর্গম জায়গায় রোবট খাবার ডেলিভারি দেয়! বোয়াও শহরের গল্পটা একটু পরে করছি। মাঝে কাতারের গল্পটা একটু বলি।
কাতারে দ্বিতীয় দিনের এসাইনমেন্ট শেষ করে আমার দুই বড় ভাইয়ের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। তারা দুজন আমাকে নিয়ে গেলেন- প্রাচীন কাতারিদের ঐতিহ্যে ঘেরা আরব সাগরের তীরে। কাতারিরা এক সময় জেলে ছিল, মাছ ধরাই ছিল তাদের মূল পেশা । আর এখন তারা অর্থবিত্তের দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্র। জেলেদের অতীত পেরিয়ে ধনীদের বর্তমান। সমাজে শৃঙ্খলা, নাগরিক জীবনে নিশ্চিন্ততা, অথচ চোখে পড়ে না কোনো রাজনৈতিক মিছিল, না কোনো ‘চাকু মুখে রাজনৈতিক বক্তা’। কাতারি নাগরিকদের সুখ শান্তি আর সামাজিক নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই। সেখানে একটা জিনিসের অভাব- রাজনীতি চর্চা । ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম বোয়াও শহরে।
চীনের বোয়াও শহরের মানুষগুলো এতো দুর্দান্ত- একটা ট্যাক্সি ঠিক করে দিতে বললে, ট্যাক্সিও ডেকে দিবে, সাথে ভাড়াটাও দিয়ে দিবে। অদ্ভুত। আমি এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি কমপক্ষে ৬/৭ বার পড়েছি। আমরা যেহেতু চায়না ভাষা জানি না, আবার চাইনিজরা ইংরেজিও বুঝে না। মোবাইলের ইন্টারপ্রেটরই একমাত্র ভরসা। কারো কাছে কেনো হেল্প চাইলে তারা কি সুন্দর গুছিয়ে সব বুঝিয়ে দিবে, অথবা আপনাকে হাত ধরে এগিয়ে দিবে। মানুষগুলো ভদ্র, মার্জিত, আত্মিক সৌজন্যে ভরা। আর এই দেশে কোথাও একটা সেবা নিতে যান, দেখবেন- আপনাকে কিভাবে নাকানি চুবানি খাওয়াবে। আপনাকে নাকানি চুবানি খাওয়ানোর পরই সেই রাজনীতির আলোচনার টেবিলে বসবে, উফফ.. দেশটা রসাতলে যাচ্ছে।
হাইনান থেকে আমরা যখন বেইজিং যাচ্ছিলাম। প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার দূরের রাস্তা। সড়ক পথে যাওয়া দূরহ। হাইকো বিমানবন্দরে গিয়ে এক ভদ্রলোককে শুধু বিমানের টিকিটের কপিটা দেখালাম। তিনি বোডিং পাস থেকে শুরু করে সিকিউরিটি চেক এবং ইমিগ্রেশন পর্যন্ত আমাদেরকে সাথে নিয়ে নিয়ে সব সুন্দর করে দেখিয়ে দিয়ে বিনা টিপসে বিদায় নিলেন। কি অসাধারণ মানুষের আচরণ। সেখানে মানুষজন শুধু সহায়-সহযোগিতার মানসিকতায় নয়, যেন আন্তরিকতার শিল্পে পটু।চীনের বোয়াও, হাইনান, হাইকো কিংবা সর্বশেষে বেইজিংয়ে মানুষগুলোর ভদ্রতা দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছি যে, আমি বুঝার চেষ্টা করলাম- তারা আসলে কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য। বাম, ডান, ইসলামিস্ট নাকি মধ্যপন্থী! না কি নিছকই মানুষ? উত্তর পাই না। কিন্তু দেখতে পাই, ওদের দেশ এগিয়ে চলছে—উদ্ভাবনে, শৃঙ্খলায়, মানবিকতায়।
কে শিবির, কে ছাত্রদল, কে এনসিপি পাকিস্তানপন্থী, কে ভারতন্থী, কে ইন্টারিম, কে পতিত রেজিমের দোসর- এগুলো নিয়ে তাদের মাথাব্যাথাই নেই। তারা একের পর এক উদ্ভাবন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। তাদের সাথে গোটা পৃথিবী এক হয়ে লাগতে আসলেও হিসেব করে আগানো লাগবে। পেকিং ইউনিভার্সিটি, চিংহুয়া ইউনিভার্সিটি পৃথিবীর সেরা বিদ্যাবিঠের তালিকায়, কিন্তু তা নিয়ে সেখান শিক্ষার্থীদের কোনো হইচই নেই। আর পৃথিবীর এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকার বাইরে থাকা ঢাবির রাজুতে গেলে মনে হয়- একটা মাছের বাজারে চলে এসেছি। প্রতিদিন এদের মাইক ভাড়াটা আসলে কে দেয়।
কাতারে আরব সাগরের তীরে যখন আমরা পৌছালাম। একটা আড্ডায় নিয়ে গেলেন বড় ভাইয়েরা। আড্ডাটা ছিল প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা বড় বড় বিজনেস পার্সোনালিটি, তাদের নিয়ে। সেই আড্ডায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এক লোক কোট টাই পরা, ভুজং ভাজং বুঝাচ্ছে সবাইকে। অনেকটা রাজি করে ফেলেছে বড় ইনভেস্টের জন্য। ভদ্রলোক পরিচয় দিয়েছেন, তিনি নাকি প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী। অথচ, আমার কাছে যে তালিকা ছিল, সেখানে তার কোনো নাম নেই। এমনকি সামিটের কোনো সেশনে তাকে দেখলাম না। আমি তাকে দুইটা প্রশ্ন করার পর সে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। আমাকে বললেন, ঢাকায় গিয়ে আপনার সাথে বসবো। আমার প্রশ্ন এবং তার উত্তর থেকে প্রবাসীরা বুঝে ফেলেছে, এই মাল ধান্দাবাজ। এরপর থেকে কাতার প্রবাসীদের আন্তরিকতায় আমি সিক্ত হয়েছি। প্রবাসীরা আমাকে হৃদয়ে জড়িয়ে নেন। আমি বুঝি, দেশ ছেড়ে আসা মানুষগুলোও এখন মগজের গুহায় আলো খোঁজে।
এই যে আমার ছবিটা দেখছেন, এটা কাতারের লুসেইল সিটিতে। এরকম গাড়ি রাস্তার কিনারে কত পড়ে থাকে। আমি একটা ছবি তুললাম স্টাইল করে। যে রাস্তার ধারে গাড়িটি পড়ে আছে কিংবা যে এলাকা ঘুরে দেখলাম উঁচু উঁচু দালান, সেখানে অমুক ভাই, তমুক ভাই নেই। অলিগিলি কিংবা রাস্তার মোড় থেকে চাঁদা উঠানোর কোনো নেতা নেই। তাই বলে কাতারে কোনো রাজনীতির চর্চা নেই? আছে! কাতারেও রাজনীতি আছে, যেসব পোলাপানকে জমি বিক্রি করে, মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে বিদেশ পাঠাইছে বাবা মা, সেসব জমিদারের ছেলেদেরকে দেখেছি, কাজ কাম বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির গুষ্ঠি উদ্ধার কইরা দিতেছে। যে মা নিজের গয়নাটা বন্ধক দিয়ে সন্তানকে বিদেশ পাঠায়, যে বাবা নিজের আজীবনের জমানো পূজি ছেলের ভিসার পেছনে খরচ করে নিঃস্ব হয়ে যায়, তারা চায় সন্তান কাজ করুক, ঘুরে না বেড়াক ফেসবুকে “দেশ বাঁচান” মার্কা পোস্ট দিয়ে।
চীনে নাকি বিরোধী দলের সদস্য হতে গেলেও পিএইচডি লাগবে।
তারা সমালোচনা করে, সেই সমালোচনা এতোটা প্রকাশ্যে হয় না। মিডিয়ায় হুদাই কেওয়াজ তৈরি করে না। সরকার শোনে। সরকার মানে। তাদের রাজনীতি আর আমাদের রাজনীতি। এই দেশের রিক্সাওয়ালারও রাজনীতি নিয়া যে চিন্তা, সে তার জীবন মান উন্নত করা নিয়ে ততটা ভাবে না। একজন চায়ের দোকানদার রাজনীতি নিয়ে যেমন ভাবে, তার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত নিয়েও সে অতটা ভাবে না। আমাদের এখানে—রিকশাচালক রাজনীতি বোঝেন, কিন্তু নিজের ছেলের স্কুলে যাওয়ার চিন্তা করেন না। চায়ের দোকানদার রাজনীতির প্যাচে থাকেন, কিন্তু বাড়ি ভাড়াটা কীভাবে দিবেন—তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
পৃথিবীর কত দেশে ফেসবুক নেই। আর আমাদের দেশের ফেসবুকে ঢুকলে মনে হবে- টকশোর বাজার, টকশোর হাট। সবমিলিয়ে ভীষণ টক্সিক। খবর নিয়ে দেখেন- অনেকের ঘরে ভাতের পাতিলটাও নেই।
ভালো থাকবেন, আমাকে ভুল বুঝবেন না। চীন কাতার সফর করে আসার পরে আমার মনে হইলো, আমার মতো গরীবের পোলার রাজনীতি নিয়ে পড়ে না থাইকা নিজের স্ত্রী, সন্তান, পরিবার নিয়ে অনেক বেশি ভাবা উচিত। আর মাঝে মাঝে এইরকম বড়লোক্স ভাব নিয়ে ছবি দিমু ফেসবুকে, কিন্তু আমারে দিয়ে আর রাজনীতির পিন্ডি চটাকাইতে পারবেন না। আমার অশান্তি লাগে। মাইনসে এতো সময় কই পায়।
ও, ভালো কথা। ভাববেন আমি সাংবাদিক মানুষ। রাজনীতি নিয়া না ভাবলে হবে? নারে ভাই, আমি সাংবাদিক না। আমি একজন শ্রমিক। সংবাদ শ্রমিক। চাকরি করি। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা। বুঝি না। জানিও না। জানি শুধু রানডাউনটা পূরণ করতে হবে। কখনো সাংবাদিক ছিলাম কিনা, মনেও নেই। বা ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারবো কিনা, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় আছে। ধন্যবাদ