আইন-অপরাধ

ক্ষতিকর রাসায়নিকে আক্রান্ত হচ্ছে ডিটারজেন্ট কারাখানার সহস্রাধিক শ্রমিক

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঘড়ি ব্র্যান্ডের ডিটারজেন্ট কারখানা বন্ধ করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর। কারখানা শ্রমিক ও পরিবেশ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর বিধায় আর্থিক জরিমানাসহ ঘড়ি ডিটারজেন্টে কারখানা বন্ধ করা হয়। তবে জানা গেছে, অধিকাংশ ডিটারজেন্ট কারখানার কর্মপরিবেশ শ্রমবান্ধব নয়। দেশে অনুমোদিত ২৩ ডিটারজেন্ট ব্র্যান্ডের জন্য কারখানার সংখ্যা ১০ থেকে ১২টি। এসব কারখানায় কাজ করেন হাজার হাজার শ্রমিক। মান্ধাতার আমলের পুরনো ম্যানুয়াল প্রযুক্তির অধিকাংশ কারাখানাতেই নেই শ্রমিকদের সুষ্ঠু কর্ম পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা। সমিক্ষা বলছে কর্মক্ষেত্রে ক্যান্সারসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে ডিটারজেন্ট কারখানার শ্রমিকরা সবচাইতে বেশি এগিয়ে। এই হিসেবের বাইরে রয়েছে আরো অসংখ্য নামে-বেনামে চলা অবৈধ ডিটারজেন্ট ও হোমকেয়ার পণ্য উৎপাদন কারখানা। যেগুলোতে কাজ করা প্রতিটি শ্রমিক রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। এজন্য সরকারের কল কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত নজরদারি ও উদাসীনতাকেও দায়ি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাইন্স ডিরেক্ট-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের ডিটারজেন্ট প্লান্টের শ্রমিকদের মধ্যে এলার্জি, স্বাসযন্ত্রের প্রদাহসহ ইনফেকশন, মারাত্মক চর্ম রোগসহ ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্তসহ দৃষ্টি ও শ্রবণ শক্তির ওপর প্রভাব ফেলছে। এসবের পেছনে রয়েছে মান্ধাতার আমলের ম্যানুয়াল পদ্ধতির হরাইজন্টাল প্লান্ট। যেগুলোতে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের সরাসরি হাতে ও মাথায় নিয়ে ডিটারজেন্টের জন্য ব্যবহৃত মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ল্যাপসা, ফসফেট, সার্ফ্যাক্ট্যান্ট, এবং অন্যান্য ক্ষারীয় উপাদানের সংস্পর্শে আসতে হয় নিয়মিত। তাছাড়া কারখানাগুলোর পুরনো মেশিনারিজগুলো ডাস্ট কালেক্টর ও সেফটি গার্ড সংযুক্ত নেই। এগুলো শ্রমিকদের ত্বক, চোখ এবং শ্বাসনালীতে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও, দীর্ঘ সময় ধরে এই রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে থাকলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, এবং অন্যান্য চর্মরোগ হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকিও দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডিটারজেন্ট তৈরীতে ব্যবহৃত রাসায়নিক থেকে মানব দেহের ত্বকের মাধ্যমে ছড়িয়ে এনজাইম নষ্ট করতে পারে। যা শরীরের প্রোটিনকে নষ্ট করে। এছাড়া অপরাপর রাসায়নিক নাকে-মুখে দিয়ে প্রবেশ করে ফুসফুসকেও আক্রান্ত করে থাকে। এগুলো আমাদের শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকির। কিন্তু আমরা যদি এখনই এসব বিষয়ে উদ্যোগ না নেই তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের শ্রমঘন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বড় ব্যাঘাত ঘটবে।
তবে দেরিতে হলেও আশার কথা যে, বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে এরই মধ্যে আরএসপিএল কোম্পানির ঘড়ি ব্র্যান্ডের ঢাকার সাভারস্থ কারখানাটি বন্ধ করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে অধীন কলকারখানা ও পতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের একটি টিম। পরিদর্শনকালে দেখতে পায় যে, কারখানার ডাস্ট নিয়ন্ত্রণ, ভ্যাকুয়েশন সিস্টেমহীন বদ্ধ জায়গা এবং প্রয়োজনীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম নেই।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ঘড়ি ডিটারজেন্টের সাভারের ফ্যাক্টরিটি মূলত অবৈধ। তার ওপর কর্তৃপক্ষ কলকারখানা অধিদফতরের অফিসারদের ম্যানেজ করে গাজীপুরের কারখানার এক্সটেনশন অংশ হিসেবে দেখিয়ে চালানো হয়। এখান থেকেই এই ডিটারজেন্ট পাউডারের সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। ফ্যাক্টরিটি শ্রমিকদের জন্যতো বটেই, সাধারণ পরিবেশের জন্যও হুমকী। বন্ধ করে দেয়ার একদিন পরেই আবার গোপনে কার্যক্রম শুরু করে। বিষয়টি নজরে এলে আবারো তা বন্ধ করে দেয়া হয়।
সূত্র বলছে, একই রকমভাবে দেশের অনেক বড় শিল্প কারখানার ডিটারজেন্ট প্ল্যান্টের পরিবেশও ভয়ংকর রকমের দূষণ ছড়াচ্ছে। এসব দূষনের প্রাথমিক শিকার কারখানাগুলোতে কর্মরত শ্রমিকরা। এছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় আশপাশের এলাকার মাটি ও পানি মারাত্মকভাবে দূষনের শিকার হলেও সরকারের কর্তৃপক্ষের নজরদারি প্রায় শূন্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কারখানার মালিকরা শুধু টাকা কামাতেই ফ্যাক্টরি চালাচ্ছে। তাদের ফ্যাক্টরির এমন অবস্থা হলে পণ্যের মানের কি অবস্থা হবে তা বোঝা যাচ্ছে। তাই শিল্প মন্ত্রণালয়কে পরিবেশ ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ ও অননুমোদিত কারখানা বন্ধে এখনই উদ্যোগ দিতে হবে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক মো. আতিকুর রহমান জানান, অধিকাংশ কারখানাই চলছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। ডাস্ট কালেক্টিং ও ভ্যাকুয়েশন পদ্ধতি না থাকায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সবচাইতে বেশি। সম্প্রতি আমরা সাভারের তেতুইবাড়ি এলাকায় অবস্থিত আরএসপিএল এর কারখানায় ঘড়ি ডিটারজেন্ট এর উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিদর্শন করতে যাই। সেখানে কর্মপরিবেশ মারাত্মক ঝুঁকিপুর্ণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় কারখানাটির উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে এর বাইরে অননুমোদিত বেশ কয়েকটি কারখানার সন্ধান পাই এবং সেগুলো সিলগালা করা হয়েছে। এসব কারখানাগুলো গ্রীন ফ্যাক্টরি নীতিমালার কিছুই মানছিলো না। তাছাড়া অননুমোদিত কারখানায় ভেজাল ও নকল এবং অনুনমোদিত ব্র্যান্ডের ডিটারজেন্ট ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে উৎপাদন করা হচ্ছিল। যেগুলো শ্রমিকদের জন্য ভয়ংকর বলে প্রমাণিত। পর্যায়ক্রমে আমরা অন্যান্য কারখানাও পরিদর্শন করবো।
জানা গেছে, খোদ ঢাকা শহরেও এমন ডিটারজেন্ট কারখানা রয়েছে যা পরিবেশ দূষণ করে চলেছে। এতে শ্রমিক ছাড়াও আশপাশের বসবাসকারীরা দীর্ঘ মেয়াদী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাহিন মোস্তফা নিলয়, মো. মোর্শেদুল হক এবং সাফি মোহাম্মদ তারেকের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রচলিত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে উৎপন্ন প্রায় সব ব্র্যান্ডের ডিটারজেন্টে এমন কিছু উপাদান শনাক্ত হয়েছে যার সংস্পর্শে ত্বকের এলার্জি, চর্মরোগ, কিডনির রোগ এমনকি জেনেটিক মিউটেশনের মতো সমস্যা হতে পারে। এছাড়া এই ডিটারজেন্ট যদি পানিতে মিশে যায় – তাহলে তা সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সঙ্গে বিক্রিয়া করে। তখন এর রাসায়নিক গঠন ভেঙে তৈরি হতে পারে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী মারাত্মক উপাদানও।
এছাড়া ম্যানুয়াল পদ্ধতির ডিটারজেন্ট কারখানার বর্জ্য পদার্থ পরিবেশে মিশে পানি ও মাটি দূষিত করে। কারখানার আশেপাশে থাকা জলাশয় ও মাটির দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিছু ডিটারজেন্ট তৈরিতে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়, যা থেকে আগুন লাগার বা বিস্ফোরণের ঝুঁকি থাকে। শুধু তাই নয় ডিটারজেন্ট কারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি থেকে উচ্চ শব্দ উৎপন্ন হয়, যা শ্রমিকদের শ্রবণশক্তি হ্রাস করতে পারে।
ডিটারজেন্ট কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার সীমিত করা প্রয়োজন। এছাড়াও, কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে নজর রাখতে হবে, যাতে পরিবেশ দূষণ না হয়। কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেও এই ঝুঁকি কমানো যেতে পারে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button