আইন-অপরাধবৃহত্তর উত্তরা

জমি দখল করতে শিক্ষকের নামে মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলা, পুলিশের টাকা দাবি- হুমকি

  • আড়াই কাঠা জমি ক্রয়, দখল পাঁচ কাঠা
  • মামলার এজাহারেও ‘দখলকৃত’ জমি উল্লেখ, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞায় আড়াই কাঠা
  • চাঁদাবাজি ও ভাংচুরের প্রমাণ পায়নি পুলিশ
  • স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিরাও মেপে বুঝিয়ে দিলেও ফের দখল
নুরুল আমিন হাসান, (ঢাকা):
রাজধানীর তুরাগের বাদালদি এলাকার প্রায় কোটি টাকা মূল্যের দেড় কাঠা জমি দখল করতে উত্তরা হাইস্কুল এন্ড কলেজের আরিফ নামের এক শিক্ষকের নামে মিথ্যা মামলা হয়েছে। অপরদিকে পুলিশকে টাকা না দেওয়ায় এমন মামলা হয়েছে বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। সেই সাথে পৈত্রিক সম্পত্তিতে গেলে ফের নারী নির্যাতন মামলার হুমকির অভিযোগও রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৪ মে ডিএমপি’র তুরাগ থানায় আফরোজা খাতুন নামের এক নারী বাদী হয়ে চাঁদাবাজি ও ভাংচুর চালিয়ে ক্ষতি সাধনের অভিযোগে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় আরিফ আহমেদ ও অজ্ঞাতনামা ১০/১৫ জনকে আসামী করা হয়।
মামলার এজাহারে আফরোজা বলেন, আরিফ ও তার সহযোগীরা আমাদের দখলীয় জমি জোরপূর্বক দখল করার পায়তারা করতেছে। সেই সাথে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছে। গত ২৩ মে আরিফ ও তার সহযোগীরা আমাদের জমিতে এসে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে তারা আমাদের জমিতে প্রবেশ করে বসতঘর ও আসবাবপত্র ভাংচুর করে।
এদিকে মামলার ঘটনার সময়ের দুটি ভিডিও ফুটেজ হাতে এসেছে। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আরিফ ও তার স্বজনরা তাদের দাবিকৃত জমি থেকে আফরোজাদের টিনশেডের রুম খুলে সরিয়ে দিচ্ছেন। আর আফরোজা, তার ভাই উমর ফারুক, সাদেক ও মা রোকিয়া বেগম সেগুলো নিয়ে যাচ্ছেন।
আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, দিয়াবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মো. মোর্শেদ আলম ও তার সঙ্গীয় ফোর্স সেখানে রয়েছে। এএসআই মোর্শেদ আরিফকে বলছেন- টাকা পয়সা হচ্ছে হাতের ময়লা। আজকে আছে কালকে নাই। এটা আপনাদের পৈত্রিক সম্পদ। আমি ক্ষতি পূরণের জন্য সাত লাখ টাকার কথা বলছি। আমি মধ্যস্থতা করতে দিতে চাচ্ছি।’
এসময় মুঠোফোনে মোর্শেদ এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘জমিটি আরিফদের পৈত্রিক সম্পত্তি। তারা তাদের কাগজপত্র নিয়েই আসছেন।’
মধ্যস্ততায় রাজি না হওয়ায় এএসআই মোর্শেদ দু’পক্ষকেই জমির কাগজ নিয়ে থানার ওসির সাথে বসার নির্দেশ দিয়ে চলে যান। আর ওই দিন থানায় না বসেই রাতে করা হয় চাঁদাবাজি মামলা।
এদিকে গত ১৬ জুন আদালতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার জন্য আফরোজারা ওই জমিতে ১৪৫ ধারায় একটি পিটিশন মামলা করেন। মামলাতেও আড়াই কাঠা জমির কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। এদিকে এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীরা জানিয়েছে, তাদের দখলে রয়েছে পাঁচ কাঠা জমি।
বিবাদপূর্ণ জমির বিষয়ে তুরাগের বাদালদি ভূমি অফিস ও জমির কাগজপত্রে ঘাটাঘাটি করে জানা যায়, জমির পর্চা, খতিয়ান, খারিজ, জমির দলিল, সিএস ও এসএ কাগজে আরিফের দাদার দাদা নছর উদ্দিন মাতব্বরের নাম। আরএস ও ঢাকা সিটি জরিপের পর্চায় রয়েছে আরিফের দাদার বাবা হাসান আলী মাতব্বরের নাম। খাজনা, খারিজে (মিউটশনে) রয়েছে আরিফের বাবা মিজানুর রহমান ও তার ভাই-বোন, বাবা-মা ও তার দাদীদের নাম।’
খোঁজখবর নিয়ে আরো জানা যায়, গত ১৩ বছর পূর্বে আফরোজাদের বাবা মৃত ফজলুল হক শহিদুল ইসলাম নামের এক সরকারী চাকুরীজীবীর কাছ থেকে জমিটি ক্রয় করেছিলেন। যার মধ্যস্থতা করেছিলেন বাউনিয়ার আব্দুল্লাহ মকিব মাসুদ। তিনি বলেন, ‘আমার স্যার আড়াই কাঠা জমি বিক্রি করেছিলেন। এখন ফজলুল হক সাহেবের সন্তানরা দ্বিগুণ জমি দখল করে রয়েছেন।’
গত মে মাসের শুরুতেই বিবাদপূর্ণ জমিটি মাপজোক করে দু’পক্ষকেই বুঝিয়ে দেয় বাউনিয়া এলাকার স্থানীয় বিএনপি’র নেতাকর্মীরা ও এলাকার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। তাদের মধ্যে আজহার আলী ও ইসহাক আহমেদ ছিলেন। তারা জানান, ‘আফরোজার বাবা আড়াই কাঠা জমি কিনেছিলেন। অথচ তারা আশেপাশের অতিরিক্ত জমি দখল করে বসে আছেন। পরে আমরা স্থানীয় ব্যক্তিরা তাদের জমিটি কাগজ অনুযায়ী বুঝিয়ে দেই। কিন্তু তারা মানে নি। পাশের আরিফদের জমিও তারা দখল করে বসে আছে।’
ভুক্তভোগী শিক্ষক আরিফ উর রহমান বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদারা ব্রিটিশ আমল থেকে ওই জমির মালিক। আমাদের জমিতে আমরা গেলে আফরোজারা বাধা দেয়, চাঁদা দাবি করে। পরে পুলিশকে খবর দিলে দিয়াবাড়ি ফাঁড়ির এএসই মোর্শেদ আলমও তাদের হয়ে সাত লাখ টাকা দাবি করেন। পরে টাকা না দেওয়ায় ওই দিনই তদন্ত না করেই আমাদের নামে মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলা দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মামলার আগে ও পরে পুলিশকে জমির সব কাগজপত্র দেখিয়েছি। আমাদের জমিতে আমরা গেলে ফের নারী নির্যাতন মামলা খেতে হবে বলে জানিয়েছেন
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দিয়াবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো. রওশন জাহান।’
অপরদিকে তার চাচা মো. মুরাদ হোসেন বলেন, ‘আমার জমিতে আমি যাবো। আমার কাগজ, আমার জমি। ওরা কিভাবে আমার জমি দখল করে রাখে, চাঁদা দাবি করে? আবার উল্টো চাঁদাবাজি মামলা দেয়?’
শুধু আরিফদেরই নয়, পাশের তানজিম সিটির জমিও দখলের অভিযোগ রয়েছে আফরোজাদের বিরুদ্ধে। তানজিম সিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আ, নু, মু, রাশেদুল ইসলাম (সায়েম) বলেন, ‘আফরোজার বাবা জমি কিনছে আড়াই কাঠা। কিন্তু তারা দখল করে আছে পাঁচ কাঠারও বেশি। এর মধ্যে আমাদের দুই কাঠা জমি দখল করে রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এক ধরণের লোক আছে, যারা অন্যের পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করে। আফরোজারা ওই রকম।’
অন্যের জমি দখল করা মামলার বাদী আফরোজা খাতুন
অন্যের জমি দখল করা মামলার বাদী আফরোজা খাতুন
জমি সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব নিয়ে চাঁদাবাজির মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে বাদী আফরোজা খাতুন বলেন, ‘আমি জমি কতটুকু মালিক, সেটা বড় কথা না। আমার দখলে আছে। এ নিয়ে আপনাকে পরিষ্কার কোন কথাই বলবো না।’
টাকা চাওয়ার বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় দিয়াবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই মোর্শেদ আলমের সঙ্গে। জানা যায়, তিনি বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলায় কর্মরত রয়েছে। মোর্শেদ আলম বলেন, ‘টাকা চাওয়ার বিষয়ে আমার জানা নেই।’
অপরদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দিয়াবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. রওশন জামান বলেন, ‘জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে মামলা হয়েছে। চাঁদাবাজির কোন তথ্য প্রমাণ আমি পাই নাই।’
তিনি বলেন, ‘আড়াই কাঠা জমি কিনেছিলেন বাদী আফরোজার বাবা। আর ওই জমির পাশেই আড়াই কাঠা জমি রয়েছে। জমিটি আফরোজাদের দখলে ছিল। আর ওই জমিতে প্রবেশ করে টিন খুলে ক্ষতিসাধন করাটাই অপরাধ হয়েছে।’
পুলিশের সাত লাখ টাকা দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই রওশন জামান বলেন, ‘জমিটিতে গর্ত ছিল। পরে জমিটি আফরোজারা ভরাট করছে। ভরাটের জন্য এএসআই মোর্শেদ পাঁচ লাখ ও টিন খুলে ফেলার জন্য ক্ষতি বাবদ দুই লাখ, মোট সাত লাখ টাকার কথা বলেছিলেন।’
নারী মামলা দেওয়ার হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই রওশন জামান বলেন, ‘একটি ফাও মামলা খাইছে না। এ ধরণের কথা বলে বেড়ালে কি আর করার।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button