নির্বাচনবৃহত্তর উত্তরা

ঢাকা-১৮ আসন চূড়ান্ত প্রার্থী বাছাইয়ে নতুন মেরুকরণ

শেষ হচ্ছে অপেক্ষার পালা :

বিশেষ প্রতিনিধি : ঢাকার অন্যতম প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত উত্তরা তথা বৃহত্তর উত্তরার সংসদীয় আসন ঢাকা-১৮। নির্বাচনী আসন হিসেবে এই আসনের গুরুত্ব সবকটি রাজনৈতিক দলের কাছেই অন্য যে কোন আসনের চাইতে বেশি। তাই প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এই আসনের মনোনিতদের দিকে বিশেষ লক্ষ্য থাকে ভোটার ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের। এবারের নির্বাচন যেহেতু একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আসতে চলেছে তাই, এখানকার প্রার্থী নির্বাচনে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দলগুলো। এরই মধ্যে বড় দলগুলোর মধ্যে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামি আন্দোলন, শাসনতন্ত্রসহ অনেকেই প্রার্থী ঘোষণা করলেও কোন প্রার্থীই ঘোষণা করতে পারেনি বিএনপি। তবে সরকার ঘোষিত রোডম্যাপ অনুসারে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় যতই এগিয়ে আসছে সব জল্পনা-কল্পনা শেষ করে দলগুলো চূড়ান্ত প্রার্থী বাছাইয়ে এগিয়ে আসছে।

দলীয় হাই-কমান্ড সূত্রগুলো বলছে, বৃহত্তর উত্তরা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৮র নির্বাচনী প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পথে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে ডিসেম্বর মাসের ৭-১০ তারিখের মাঝেই। সেই তফসিলের দিকেই তাকিয়ে আছে বৃহত্তর উত্তরার (উত্তরা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, তুরাগ আর খিলক্ষেত নিয়ে গঠিত) ঢাকা-১৮ আসনের বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ও জনগণ।

ঢাকা-১৮ আসন মূলতঃ দলীয় ইমেজ বৃদ্ধির আসন। অতীতে যেই দলই ক্ষমতায় এসেছে তারা এই আসনে জয়লাভ করেছে। এই আসনে ১৯৯১ সালে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সে হিসেবে এবারো এই আসনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমানের নাম নিশ্চিত করেছে দলীয় সূত্রগুলো। তবে তারা কেউ একে অপরের বিরুদ্ধে ভোটের মাঠে দাঁড়াবেন না-এটা মোটামুটি নিশ্চিত। দুজনের যে কোন একজন ঢাকা-১৮ তে নিজের দ্বিতীয় আসন হিসেবে দাঁড়াবে-এজন্য এই আসনে বর্তমানে দু‘দলের কোন প্রার্থীই জোড় কদমে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন নাই। এই আসনে ইতোমধ্যে যারা গণসংযোগ শুরু করেছেন, তাদের মধ্যে এগিয়ে আছেন জামায়াতের অধ্যক্ষ আশরাফুল হক, শহীদ মীর মুগ্ধের ছোট ভাই মীর স্নিগ্ধ, বিএনপির এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন এবং এনসিপির নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারি। কিন্তু এসব প্রার্থীদের কাউকেই দলীয় গ্রীন সিগন্যাল দেয়া হয়নি। বিএনপির অন্তর্কোন্দলের সুযোগে মাঠে শুধুমাত্র জামায়াতের প্রার্থীর কিছু গণসংযোগ চোখে পড়লেও তা নির্বাচনী প্রচারণার উল্লেখযোগ্য কর্মতৎপরতা নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষজন।

এই আসনে এর আগে নমিনেশন পেলেও প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারেননি এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন। বিএনপির পক্ষে স্থানীয়দের মধ্যে মনোনয়ন দৌড়ে তিনি এগিয়ে থাকলেও এবার হয়তো তাকে খালি হাতেই ফিরতে হবে। কারণ স্থানীয় অপর নেতৃবৃন্দ জাহাঙ্গীরের সরাসরি প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করেছেন। বিএনপির মহানগর উত্তর সদস্য সচিব হাজী মোস্তফা জামান, যুগ্ম আহ্বায়ক এম, কফিল উদ্দিন আহমেদ, মো: আফাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান সেগুন ও দক্ষিণখান থানা আহ্বায়ক হেলাল তালুকদারসহ স্থানীয়রা একতাবদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম নামে একটি আলাদা মোর্চা গঠন করেছেন এস এম জাহাঙ্গীরকে ঠেকাতে। দুই গ্রুপই এরই মধ্যে আলাদাভাবে শোডাউন করেছেন উত্তরায়। এরই মধ্যে কফিল উদ্দিন ও আফাজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও তাদের সম্পদের শেল্টার দেয়া নিয়ে। তাছাড়া ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এই গ্রুপটির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও অপকর্মেও শেল্টার ও মদদ দেয়ার অভিযোগ উঠে। তাই দলীয় হাইকমান্ড প্রার্থী তালিকায় বিতর্কিত এদের কাউকে মনোনিত করে আসন হারানোর ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। সেই বিকল্প চিন্তায় নতুন খোরাক জুলাই আন্দোলনে আলোচিত শহীদ মীর মুগ্ধের ভাই মীর স্নিগ্ধ।

বিএনপি থেকে মীর স্নিগ্ধকে দলীয় সমর্থন দেওয়া হলেও তার নির্বাচনী আসন কোথায় হবে অথবা আদৌ বিএনপি মীর স্নিগ্ধকে নির্বাচনী প্রার্থী করবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। অপরদিকে বেশ কয়েকদিন এই এলাকার বিএনপির সাবেক সাংসদ কামরুল ইসলামের নাম শোনা গেলেও সংস্কারপন্থী হিসেবে তার নামও বাদ পড়েছে। তাই শহীদ জিয়ার স্মৃতিধন্য ও বেগম জিয়ার সাবেক আসন বলে এলাকার মানুষ মনে করছেন এবার তারেক জিয়া অথবা তার স্ত্রী জোবায়দা রহমান উক্ত আসনের প্রার্থী হবেন। লন্ডন থেকে ফিরে ইতোমধ্যে জোবায়দা রহমান এই আসনের ভোটার হয়েছেন। বৃহত্তর উত্তরার দক্ষিণখানের আর্মি সোসাইটিতে শহীদ জিয়ার একখন্ড জমি এখনো আছে। এখানেই বেগম জিয়া এমপি ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে জিয়া পরিবারের হাতেই থাকছে এই আসন।

বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত কমিটির বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে, দেশে আসার পর বগুড়ায় নির্বাচনী ক্যাম্পেইন এ একবারের বেশি তারেক জিয়ার যাওয়ার সুযোগ হবে না বিধায় উত্তরায় তিনি দ্বিতীয় আসন হিসেবে নির্বাচন করবেন। আর সেটাও সম্ভব না হলে জোবায়দা রহমান বা মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান এই আসনের প্রার্থী হবেন। ধারণা করা হচ্ছে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী ছাড়া এই আসনের ভোটারদের মন যেহেতু জয় করা সম্ভব হবে না, তাই জিয়া পরিবারের ঐতিহ‌্য টিকিয়ে রাখতে এবং আসন নিশ্চিত করতে এমনটি করা হতে পারে।

অন্যদিকে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের জন্মস্থান মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) এ দ্বিতীয় আসন হিসেবে প্রার্থী হওয়ার কথা থাকলেও উনি সেখানে প্রার্থী হবেন না এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কুলাউড়াতে জামায়াতের জিতে আসার মতো শক্ত প্রার্থী আছে। দলীয় প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একাধিক আসনে প্রার্থীতা চূড়ান্ত করার ইতিহাস খুবই স্বাভাবিক হলেও জামায়াতের কোন আমীর এখন পর্যন্ত একাধিক আসনে প্রার্থী হননি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে যেই আসনে ডা. শফিকুর রহমান সবচেয়ে বেশি সময় দিয়েছেন, তা ঢাকা-১৮ আসন। বিগত ফ্যাসিস্ট সময়ে এবং ফ্যাসিস্ট পরবর্তী সময়েও আমীরে জামায়াত নিয়মিত উত্তরায় ইতিকাফ, ঈদ উদযাপন উপলক্ষ্যে জনসাধারণের দোড়গোড়ায় গিয়েছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের জানাজায় উপস্থিত থেকেছেন আওয়ামী বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করেই। ৫ আগস্ট পরবর্তীতে নিয়মিত জুমার নামাজের আগে-পরে গণসংযোগ করেছেন ঢাকা-১৮ আসনে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে জুমার নামাজ ছাড়াও সপ্তাহে অন্তত একদিন তিনি উত্তরা সফরে আসেন। দলীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ এই আসনে জামায়াত-শিবিরের দলীয় প্রভাব এবং ডা. শফিকুর রহমানের ব্যাপক ইমেজ ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেননি বর্তমান মনোনীত প্রার্থী অধ্যক্ষ আশরাফুল হক। এ বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মিডিয়া বিভাগের সাথে বর্তমান প্রার্থীর বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে হতাশার সুর শোনা যায়। যদিও শুক্রবার তার পক্ষে উত্তরায় এ যাবত কালের সবচাইতে বড় শোডাউন হয়েছে। দাড়িপাল্লা মার্কার পক্ষে এমন শোডাউনের পর ধারণা করা হচ্ছে, পূর্বঅভিজ্ঞ আশরাফুল হকই থেকে যাবেন জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে।

অন্য একটি সূত্র মতে, শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্বাচনের অনুমতি দেয়া হলে ঢাকা-১৮ থেকে মনোনয়ন দেয়া হতে পারে বর্তমান শিবির সভাপতি জাহিদুর রহমান বা ভিপি সাদিক কায়েমকে। যদিও কয়েকদিন আগে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের সূত্রে এ আসনে জুলাই অভ্যুত্থানে অগ্রসৈনিক হিসেবে পরিচিত সিবগাতুল্লাহ সিবগার নাম শোনা গিয়েছিল। কিন্তু করে সে সম্ভাবনা বাতিল করা হয়। শিবির সভাপতি জাহিদুর রহমান ডিসেম্বরেই তার মেয়াদ শেষের পর জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন। সে ক্ষেত্রে এমপি ইলেকশানে সবার শুরুতে তাকেই চাইবে জামায়াত এবং ছাত্রদের জন্য একটি আসন বরাদ্দ হলে তা হবে উত্তরা। কারণ জুলাই গণ অভ্যুথানে উত্তরায় শতাধিক শহীদের মাঝে শহীদ পারভেজ, মাওলানা জসীমউদ্দিন, নূর, আব্দুল্লাহ আত তাহির ছিলেন জামায়াত-শিবিরের সরাসরি জনশক্তি। মারাত্মক আহত হন মহানগর উত্তর শিবিরের নেতা তাহমিদ হুজায়ফা, রাহাতসহ আরো অনেকে। উত্তরার রাজনীতি অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করে শিবিরের বর্তমান ও সাবেক নেতারা। এমতাবস্থায় প্রেস্টিজিয়াস এই আসন কোনভাবেই তারা হাতছাড়া করতে চাইবে না নিশ্চয়ই। শিবিরের প্রার্থীতা বিষয়ে কেন্দ্রীয় মিডিয়া বিষয়ক সম্পাদক আজিজুর রহমান আযাদের (যিনি নিজেও এ আসনের স্থায়ী বাসিন্দা) সাথে যোগাযোগ করা হলে, উনি চমকের জন্য আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে বলেন সবাইকে।

তবে ইসলামি আন্দোলনের পক্ষ থেকে মনোনিত আলহাজ্ব মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন নির্বাচনের মাঠে শেষ পর্যন্ত তারা থাকবেন। দলের পক্ষ থেকে তাকে মনোনয়ন দিলেও ৮ দলীয় জোট হওয়ার সম্ভাবনা থেকে তিনি এখনো সক্রিয়ভাবে প্রচারণায় নামেন নি। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণার পর দল বা জোট থেকে যাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তার পক্ষেই কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। এ উপলক্ষে শুক্রবার বিশাল বড় একটি শোডাউনও করেছে চরমোনাই পীরের অনুসারী এই দলের নেতা-কর্মীরা। আনোয়ার হোসেন মুক্তমনকে বলেন, আমি আসলে অপেক্ষায় আছি। জোট নির্বাচন পর্যন্ত এক থাকলে এবার হয়তো আমার প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা হবে না। কারণ এখানে আশরাফুল হক স্যারকে মনোনয়ন দিলে আমাদেরকে তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। তবে আমাকে দিলে তারা আমাদের পক্ষে কাজ করবে। তবে যেহেতু এবার জোট হলেও নির্বাচনে প্রত্যেককেই নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে, তাই আমরা আমাদের মার্কার প্রচারে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি।

এদিকে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারি ঢাকা-১৮ থেকে ইতোমধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এনসিপি থেকে তার মনোনয়ন একপ্রকার নিশ্চিত। তবে যেহেতু এখনো পর্যন্ত এনসিপি বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে চাইছে, তাই এই জায়গায় বিষয়টি ঝুলে আছে। সব সমীকরণ মিলিয়ে এটাই মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে উত্তরা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান বা দ্বিতীয় প্রধান নেতৃবৃন্দই শেষমেষ নির্বাচনে লড়বেন ও এমপি হবেন। তবে তারেক জিয়া বা ডা. শফিকুর রহমান কেউ কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা আগেভাগেই না দিয়ে সজাগ চোখ রেখেছেন দুই দলের মনোনয়নের উপর।

মনোনয়ন ইস্যুতে স্থানীয় ভোটররাও রয়েছেন বিভ্রান্তিতে। তারা বলছেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজেদের মনোনয়ন নিতে পোস্টার, ফেস্টুন আর দলীয় রেশারেশি চালিয়ে গেলেও ভোটার কেন্দ্রিক কোন কর্মকাণ্ড করছেন না। বিশেষ করে বিএনপির প্রার্থীরা পারস্পরির দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকাশ্য করেছেন যে, বিষয়টি রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। অন্যসব এলাকার মতো খুনোখুনি বা হানাহানির আশঙ্কাও করছেন সাধারণ ভোটাররা। তবে সবকিছুই দৃষ্টিতে রেখেছেন তারা। এবারের নির্বাচনে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে থাকা নতুন ভোটাররাও করছেন বিচার বিশ্লেষণ। চায়ের আড্ডা থেকে খেলার মাঠ সর্বত্রই প্রার্থীদের কার্যক্রম এখন আলোচনায়। এই আলোচনার শেষটা ভোটের মাধ্যমেই দিতে চান তারা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button