ঢাকা-১৮তে এস এম জাহাঙ্গীরকে পেল বিএনপি


বিশেষ প্রতিনিধি : এ যেন সব জল্পনায় জল ঢেলে দেয়া। গত ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ টি আসনে বিএনপির মনোনিত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করেন। সে সময়ে আসন ঘোষণা বঞ্চিত ছিলো ঢাকা-১৮ তথা বৃহত্তর উত্তরার (উত্তরা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, তুরাগ আর খিলক্ষেত নিয়ে গঠিত) গুরুত্বপূর্ণ এ আসন। তবে আজ ৪ ডিসেম্বর ঠিক একমাসের ব্যবধানে আরো ৩৬ জনের মনোনয়ন ঘোষণা করেছে বিএনপি। আর তাতেই জল্পনায় জল ঢেলে ঢাকা-১৮ আসনের জন্য বিএনপির কান্ডারি হিসেবে মনোনিতে করা হয়েছে এস এম জাহাঙ্গীর হোসনকে।
মনোনয়ন যোগ্য প্রার্র্থী হিসেবে সবার সব বিচারে এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন এগিয়ে থাকলেও ১ম ঘোষণাতে মনোনয়ন না পাওয়ায় দলের অপরাপর প্রার্থীদের জন্য একটি সুযোগ তৈরী হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এরই মধ্যে জুলাই অভ্যূত্থানের অন্যতম শহীদ মীর মুগ্ধের ভাই মীর স্নিগ্ধ বিএনপিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদেন। এরপর সৃষ্টি হয় আরো একটি ধারা। মীর স্নিগ্ধ দলীয় কয়েকটি অনুষ্ঠানেও যুক্ত হন। তাকে দেখা যায় খোদ ঢাকা-১৮ আসনেই জনসংযোগ করতে। এই চিত্রের পর অনেকেই বলাবলি করছিলেন যে, তবে কি মনোনয়ন যাচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানে মীর মুগ্ধের ভাইয়ের কাছে?
শুধু কি তাই? ১ম দফায় মনোনয়ন ঘোষণার পর উত্তরার বিএনপি কার্যত দুই ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব হাজী মোস্তফা জামান, যুগ্ম আহ্বায়ক এম. কফিল উদ্দিন আহমেদ, মো: আফাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান সেগুন ও দক্ষিণখান থানা আহ্বায়ক হেলাল তালুকদারসহ স্থানীয়রা একতাবদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম নামে একটি আলাদা মোর্চা গঠন করেন এস এম জাহাঙ্গীরকে ঠেকাতে। দুই গ্রুপই এরই মধ্যে আলাদাভাবে শোডাউন করেন উত্তরায়। এসব শোডাউনেও কারিশমা দেখান এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন।
এর বাইরেও আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে উত্তরায় বিএনপির রাজনীতিতে। অনেকটা আড়ালে থাকা রাজনীতিবিদ বাহাউদ্দিন সাদী। তার পক্ষ থেকে ব্যতিক্রমী পোস্টারিং এবং জুলাই অভ্যূত্থানকে ধারণ করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের দেখানো আদর্শে সৌহার্দ্য, পরিবর্তন ও শান্তির বার্তা নিয়ে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবকদলসহ অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা শোডাউন করেন। মিছিলে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক সহ সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান সাগীরের নেতৃত্বে বিএনপি, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি ও উত্তরা পশ্চিম থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মোস্তফা কামাল হৃদয়ের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক দল, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সদ্য সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসান রুয়েলের নেতৃত্বে যুবদল এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি রবিউল আওয়াল ভূঁইয়া রবির নেতৃত্বে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সৌহার্দ্য, পরিবর্তন ও শান্তির বার্তা নিয়ে মিছিলে অংশ নেন।
তার সেই শোডাউনের পর বিএনপির রাজনৈতিক কার্যক্রম খন্ড খন্ড হয়ে যায়। আর বিষয়টি টের পেয়ে দলীয় হাইকমান্ড জরুরী বৈঠকে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনে। বিএনপি আন্তঃকোন্দল ঠেকিয়ে এই আসনকে জয়ের ধারায় আনতে সকল প্রার্থীদের কার্যক্রম, মাঠের অবস্থান, রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড এবং বিগত ও সাম্প্রতিক সময়ে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে উঠে আসা নানা অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে।
বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) সংবাদ সম্মেলন শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাপ্তাহিক মুক্তমনকে বলেন, “আমরা আসলে যাচাই করার জন্য সময় নিয়েছিলাম। তাই সবশেষ যে রিপোর্ট পেয়েছি সে অনুযায়িই দল সিদ্ধান্ত দিয়েছে “ নতুন ৩৬ জনের জন্য সিদ্ধান্ত ফের পরিবর্তন হয়ে যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এবার যাদের নাম এসেছে তাদের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তারা কঠিন বাছাইয়ে পাস করেছে।”
এর আগে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি দ্বিতীয় ধাপে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরও ৩৬ জন প্রার্থীর নাম প্রকাশ করেন। এর আগে ঘোষিত ২৩৭ জনসহ মোট প্রার্থী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭৩ জনে।
নতুন তালিকায় ঢাকা- ১৮ আসনের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন। তার মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই এলাকায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে।
২০ সালের উপনির্বাচনে তিনিই ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। এবারও শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় তার মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। তবে জোটের হিসেব-নিকেষের কারণে এ আসনে মনোনয়ন ঝুলে যায় জাহাঙ্গীর হোসেনের। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় এস এম জাহাঙ্গীর বিগত সরকারের সময়ে ৩০০টির বেশি রাজনৈতিক মামলার মুখে পড়েন। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দলের প্রতি তার নিষ্ঠা এবং তৃণমূলের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্কই তাকে এই মনোনয়নে এগিয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দলীয় নেতারা।
মনোনয়ন পাওয়ার পর এস এম জাহাঙ্গীর সাপ্তাহিক মুক্তমনকে বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর দরবারে অশেষ শুকরিয়া, যে দল আমার ওপর বিশ্বাস রেখে আমাকে মনোনিত করেছে। আমি শুকরিয়া জানাই এজন্য যে, আমাদের দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার শারিরীক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সে জন্য তাকে আজ রাতেই বিদেশে নেয়ার জন্য সুযোগ তৈরী হয়েছে। যারা নেত্রীর জন্য দোয়া করেছেন তাদের কাছেও আমরা দলের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞ। আমি আরো কৃতজ্ঞ যে, আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান দলের তৃণমূলের একজন কর্মী হিসেবে আমার উপর আস্থা রেখেছেন। আমি চাই দলের সেই আস্থার প্রতিদান দিতে। সকলের কাছে দোয়া চাই যেন এ এলাকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারি তারেক রহমানের নির্দেশকে সামনে রেখে। আমাদের যত নেতা-কর্মী আছে সবার মন জয় জয় করে আমি যাতে কোন রকম কোন অপরাজনীতির শিকার না হই এবং সবাইকে নিয়ে সুন্দরভাবে নির্বাচনে বিজয় আনতে পারি।”
এদিকে উত্তরায় সুস্থ্য রাজনীতির অন্যতম বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। বিশেষ করে এস এম জাহাঙ্গীরের নমিনেশন নিশ্চিত হওয়ার পর নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন জামায়াতের ঢাকা-১৮ আসনের প্রার্থী অধ্যক্ষ আশরাফুল হক। তিনি লিখেন, “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কর্তৃক ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী মনোনীত হওয়ায় জনাব এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন সাহেবকে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। আশা করি, আমরা সবাই জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে এবং এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সুস্থ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখব। নির্বাচনী মাঠে সকলের জন্য শুভ কামনা রইল।”
https://www.facebook.com/share/p/1KPvFjeKh8/
নেতাকর্মীরা মনে করছেন, প্রথম ধাপে প্রার্থী প্রকাশ না হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিএনপির প্রার্থীরা পারস্পরির দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকাশ্য করেছেন যে, বিষয়টি রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাড়িয়ে যায়। রীতিমতো পাল্টা-পাল্টি শোডাউন আর পারস্পরিক কাঁদা ছোড়াছুড়িতে তৈরী হয় অস্থিরতা। বিষয়টি যেন টের পেলেও এস এম জাহাঙ্গীর দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাননি। দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি তার আস্থা তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মাঝে তার জনপ্রিয়তা আরো বাড়িয়ে তোলে। তাছাড়া মাঠপর্যায়ের নির্বাচন নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা আসন্ন নির্বাচনে বিএনপিকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে রাখবে বলেও মনে করছেন তারা। বিশেষ করে এবারের নির্বাচনে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে থাকা নতুন ভোটাররাও চাইছেন তাদের উপযোগী একজন প্রার্থী। চায়ের আড্ডা থেকে খেলার মাঠ সর্বত্রই এস এম জাহাঙ্গীরের কার্যক্রম এখন আলোচনায়। এই আলোচনার শেষটা ভোটের মাধ্যমেই দিতে চান তারা।



