জামায়াতের সমাবেশ বিএনপির পিআর এনসিপির পদযাত্রা!!

মানিক মুনতাসির : যে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের ম্যাচুরিটি বা অভিজ্ঞতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিষয়। তারচেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে কৌশল। ঢাকার অনেক বিল্ডিং এর দেয়ালে বিভিন্ন সময় একটা বাক্য লেখা দেখতে পাওয়া যায় সেটা হল “কায়দা করে বেঁচে থাকো আইজুদ্দিন”। এই কায়দা বা কৌশল যে জানে না সে আসলে পৃথিবীতে কিছুই পারে না। আপনি যতই মেধাবী হউন, যতই শিক্ষিত হউন, আপনি যদি কৌশলী না হন কৌশল না জানেন তবে আপনি সমাজের কোন উপকারেই আসবেন না।
এনসিপির ক্ষেত্রে অনেকটা সে রকমই হয়েছে। এনসিপির ছেলেরা যেহেতু রাজনীতিতে নতুন নেমেছে- তাদের সীমাবদ্ধতা, অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কৌশলের অভাব থাকবে কেন। যদিও সেটাই হচ্ছে। দেশব্যাপী জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে- এক গোপালগঞ্জকে ঘিরে যা ঘটেছে সেটাকেও ছাপিয়ে গেছে আজকে নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারীর বিএনপি নেতা সালাউদ্দিনকে নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করার বিষয়।
যার ফলে জামাআতে ইসলামের সাথে বিএনপি’র দূরত্ব যতটা বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে এনসিপির সাথে। আর বিএনপি’র লোকেরাও এনসিপির ছেলেদেরকে নিয়ে এত বেশি অশালীন কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন যেটা আসলেই এ সময়ের রাজনীতিতে খুবই বেমানান।
১৯৪৭ সালে জামাআতের প্রতিষ্ঠার পর হয়তো এত বড় সমাবেশ তারা এর আগে কখনোই করতে পারে নাই। এমনকি ২০০১ থেকে ২০০৫ সময়ে সময়ে সরকারে থাকা সত্ত্বেও এত বড় সমাবেশ তারা করতে পারে নাই।
আর আজকে সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া জামাআতের আমির ডাক্তার শফিকুর রহমান যে কৌশল, মনোবল এবং যে সাহস দেখিয়েছেন তাতে দলটির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের প্রতিও আজকে তিনি বিশেষ আকর্ষণ তৈরি করেছেন বলে আমার ধারণা। যদিও ডাক্তার শফিকুর রহমানের হঠাৎ অসুস্থ হওয়াকে অনেকেই অভিনয় হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন অবশ্যই সেটা নির্বুদ্ধিতা এবং দুঃখজনক। একথা অনস্বীকার্য যে ডাক্তার শফিকুর রহমান একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে এবং দলটির আমির হিসেবে নতুন এক রেকর্ড গড়লেন।
একই সঙ্গে বিএনপি, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন সহ অন্য আরো কয়েকটি দল আজকে দারুন এক কৌশল দেখিয়েছে ডাক্তার শফিকুর রহমানের অসুস্থতার বিষয়ে। তাৎক্ষণিকভাবে তারা ছুটে গিয়েছেন হসপিটালে। যা ঘুনে ধরা পচা দুর্গন্ধযুক্ত রাজনীতিতে এ সময় এক গুণগত পরিবর্তন আনবে বলে ধারণা করা যায়। এটাকেই তো রাজনৈতিক আচার এবং রাজনীতির সৌন্দর্য হিসেবে ধরে নেয়া যায়।
জামাআতের সমাবেশে কত লোক হয়েছে সফল হয়েছে কি হয় নাই সেগুলো প্রশ্ন নয়। বরং প্রশ্ন হচ্ছে ডাক্তার শফিকুর রহমান বক্তৃতাকালে দুই দুইবার অসুস্থ হয়েও, এমনকি জ্ঞান হারিয়েও জ্ঞান ফেরার পর বসেই বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন। যা সত্যিই প্রশংসনীয়।
এদিকে সংখানুপাতিক হারে বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে বিএনপি। কেননা এই পদ্ধতিতে ভোট হলে যে দল একটি সিটও পাওয়ার কথা নয় কিংবা গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বার ইলেকশনে জেতারও ক্ষমতা নেই তারাও হয়তো সংসদে প্রতিনিধিত্ব পাবে। এতে করে এ সময়ের প্রধান দল হিসেবে বিএনপি’র আধিপত্য কমবে। এতে জামাআেত ইসলামের আধিপত্য বাড়বে নাকি কমবে সেটা অবশ্য এখনই বলা সম্ভব নয়।
তবে এ কথা সত্য যে পিআর পদ্ধতিতে ভোট না হলে এনসিপি সংসদে কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এমনকি ভোটের পর তারা সরকারের অংশ হতে না পারলে ছাত্রদের এবং এনসিপির অনেক নেতার অস্তিত্ব নিয়েও টানাটানি উঠে যেতে পারে। ফলে যারা এত বড় একটা স্বৈরাচার সরকারকে হটিয়েছে দেশ পুন:গঠনে তাদেরকে অবশ্যই দরকার আছে। এজন্যই হয়তো ডক্টর ইউনুস সহ অন্যান্য সবাই পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন করাকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে।
সবশেষে- বলি মানুষের পালস বুঝে রাজনীতি করাটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কৌশল। যেটা শেখ মুজিবুর রহমান সবচেয়ে ভালো পারতেন এরপর শেখ হাসিনা সেটা খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। কিন্তু কৌশলে ভুল করার কারণে শেখ হাসিনার শেষ রক্ষা হয়নি। একই ভুলের কারণে তার বাবারও শেষ রক্ষা হয়নি।
এই কৌশলে জামাআতে ইসলাম অনেক পিছিয়ে। এনসিপিও পিছিয়ে। জামাআতে ইসলাম যতটা না সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করে তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতি করে নিজ দলের নেতাকর্মীদের জন্য। এ কারণেই জামাআতে ইসলামের ভোট বাড়ে না। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত দলটি দেশের জনসংখ্যার বা মোট ভোটারের বিশ শতাংশ নিজেদের সমর্থন নিতে পারেনি। অথচ হাজার হাজার মানুষকে গুলি করে মারার পরও দেশে এখনো ২৫ শতাংশের বেশি আওয়ামী লীগের সমর্থক আছে বলে করা যায়।
অনেকটা এই জামাআতে ইসলামের পথেই হাঁটছে এনসিপিও। কেননা তারাও জনগণের পালস বুঝতে ভুল করতেছে অবশ্যই এটার জন্য তাদের ইম্যাচুরিটি একটা বড় বিষয়। বিএনপি যদিও এই মুহূর্তে জনগণের পালস যতটা না বুঝতেছে তার চেয়ে বেশী বুঝতেছে শত্রু বৃদ্ধির ব্যাপারে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক