পিএসএল-আইপিএল অনিশ্চিত। বিশ্বের তাবৎ ক্রিকেটপ্রেমীদের এখন একটাই ভরসা, বাংলাদেশের সেলিব্রেটি ক্রিকেট লীগ।

জয়নাল আবেদীন : ক্রিকেট খেলা হিসেবে সত্যি বলতে সবচেয়ে বোরিং। একে আকর্ষণীয় করার জন্য খোদ আইসিসি বছর বছর নিয়ম পাল্টায়, পাল্টে ফেলে ফরম্যাট। একেক লীগ নিয়ম বানায় একেক রকম।
বাংলাদেশের সেলিব্রেটি ক্রিকেট লীগ সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। এটা বিশ্বের ইতিহাসের একমাত্র স্পোর্টস ইভেন্ট যেখানে মূল খেলার চেয়ে প্র্যাক্টিস সেশন বেশি আকর্ষণীয়। প্র্যাক্টিসের টিআরপি মূল ম্যাচের চেয়ে বেশি। কম্পিটেটিভ ম্যাচে ছোট বড় ব্যক্তিগত সব মিলিয়ে যতগুলো ক্যামেরা এক্টিভ থাকে, প্র্যাক্টিসে ক্যামেরা চালু থাকে তারচেয়ে অন্তত ৫০ গুণ বেশি।
তারচেয়েও বিস্মিত হবার মতো ব্যাপার আছে। প্র্যাক্টিসে সেশনের ক্যামেরাগুলো সচরাচর ক্রিকেট প্র্যাক্টিস দেখায় না। তারা দেখায় অনুশীলনের ফাঁকে প্লেয়াররা কী কী করছেন।
সেলিব্রেটি ক্রিকেট লীগ ফলো করতে গিয়ে তাই আমরা দেখি নীলা নামের এক মডেল প্রচন্ড আবেগ নিয়ে কলা খাচ্ছেন। কলা খাওয়ার পুরো প্রসেসটা আসে ক্যামেরায়। ভীষণ ইন্টেন্স দৃশ্য। আমরা দুরুদুরু বুকে দেখি নাদিয়া মাঠের এক কোণায় দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছেন, চেক করছেন মুখের মেকাপ। আমরা প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে দেখতে পাই কেয়া পায়েল পা ছড়িয়ে বসে নেটে হেলান দিয়ে ফোনে কথা বলছেন কারো সাথে।
ক্রিকেট বোরিং আগেই বলেছি। ক্রিকেটকে আকর্ষণীয় করতে এসেছে টি-টুয়েন্টি। অতিমাত্রায় চার ছক্কা দেখতে দেখতে এটাও এখন বোরিং লাগে। আপনিই বলেন আইপিএল যতটা আগ্রহ নিয়ে আগে দেখতেন, এখন দেখেন? বিপিএলের একটা পুরো ম্যাচ লাস্ট দেখছেন কবে?
ক্রিকেটকে আকর্ষণীয় করতে বাংলাদেশের সেলিব্রেটি ক্রিকেট লীগ এক ঐতিহাসিক ও তাক লাগিয়ে দেয়া পদক্ষেপ। এখানে আপনি কিছুই আগে থেকে প্রেডিক্ট করতে পারবেন না। কোন তারকা কী পোশাক পরে মাঠে ঢুকবে কেউ জানে না। যে যার মতো পোশাক পরে, যার যা ইচ্ছা তাই করে। কোনো বাধা নাই, কোনো নিয়ম নাই।
নায়িকাদের কলা খাওয়া, ফোনে কথা বলা, গায়ের জামা (এসব জামার নাম জানি না) সামান্য উঠে গেলে টেনে আবার নামিয়ে নেয়া এইগুলোর ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমাঝে ক্রিকেট খেলার ক্লিপও আসে। সেই ক্লিপগুলো চমকপ্রদ।
বোলার তিন পা গুটি দৌঁড় দিয়ে ছোট্ট লাফ দিয়ে মার্বেল মারার মতো বল ছুঁড়েন। ঝাঁড়ুর মতো ব্যাট ধরে উবু হয়ে অপেক্ষা করেন ব্যাটসম্যান। বল ড্রপ খায়। একটা, দুইটা, তিনটা, অনেকগুলো। ব্যাটসম্যান ঝাঁড়ু নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে একটা ঘোরান্টি মারেন ব্যাটসমেত। ব্যাটের গতি জড়তায় ব্যাটসম্যান চলে যান পীচের বাইরে। বল তখনো ড্রপ দিচ্ছে। এখনো স্ট্যাম্পের কাছাকাছি যায়নি।
ক্লাইমেক্স, উত্তেজনা৷ এড্রেনালিন রাশ। বল ঠিক কখন ক্রিজ পার হবে?
কিছু সময় ক্লাইমেক্স আরো গভীর হয়। স্ট্যাম্প পশ্চিম দিকে থাকলে বোলার বল মারেন উত্তর বা দক্ষিণে। আইপিএলে বলের আগে হয়তো আপনি ধারণা করতে পারবেন বলটা কোথায় পীচ করবে, রেজাল্ট কী হবে। এখানে আপনার দাদার সাধ্য নাই বলেন, বল উত্তরে যাবে নাকি দক্ষিণে। পরস্পর ৬০ থেকে ৯০ ডিগ্রি কোণে একে অপরকে বিদায় জানানোর সময় বল ব্যাটকে যেন বলে “তোমার সঙ্গে আমার কিংবা আমার সঙ্গে তোমার, আর কোনোদিন দেখা হবে না।”
কিছু বিরল দৃশ্যে ব্যাটে বলে সংযোগ হয়ে যায়। তখন ঘটে আরো চমৎকার ঘটনা। বল ফিল্ডারের দিকে যাচ্ছে, ফিল্ডার বলের দিকে আসছে। ব্রিজের দুই সাইড থেকে গানের ফাঁকে নায়ক নায়িকা যেমন ধেয়ে আসে পরস্পর। কিন্তু দুইটা ক্রিকেট বল তো সাইজে নায়কের চেয়ে ছোট, তার জড়িয়ে ধরার মতোন হাত নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বল নায়িকাকে ধরতে পারে না, নায়িকাও বলকে ধরতে পারে না। দুজন দুজনকে ক্রস করে চলে যায় যে যার দিকে। প্লেয়ার কিছুদূর সামনে গিয়ে ব্রেক করে আবার উল্টো ঘুরে। এদিকে ব্যাটসম্যান পিস্তল উঁচিয়ে রাখার মতো করে ব্যাট তুলে ধরে দৌঁড়ায় রানের জন্য। বেচারা আম্পায়ারদের ধৈর্যের অবসান ঘটে। বল অর্ধেক মাঠে থাকতেই সে চার দিয়ে নাটক বন্ধ করে।
বাংলাদেশের সেলিব্রেটি ক্রিকেট লীগ শুধু খেলা নয়, এটা একটা বিপ্লব। এটা এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম বিদ্রোহ। এখানে খেলার আড়ালে নীরবে ঘোষণা করা হয় মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। সমাজ ও পৃথিবী মানুষকে নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ করে নিষ্পেষিত করার বিরুদ্ধে স্পষ্ট বার্তা এই লীগ।মানুষ থাকবে স্বাধীন, মানুষ খেলবে স্বাধীন। নিয়ম আবার কী?
যুদ্ধরত অশান্ত জগতের প্রতি বাংলাদেশের সেলিব্রেটি লীগ একটা শান্তির বার্তা। এখান থেকে মেসেজ দেয়া হচ্ছে পৃথিবীকে। হে জগত, এত উন্মাদ হয়ে কী লাভ? দুইদিনের দুনিয়া, একদিন তো এমনিই মরবা। যুদ্ধ, মিসাইল, রক্ত এসব দেখার মানে নাই।
তারচেয়ে টিভি ও ফোন খুলে দেখো সেলিব্রেটি লীগের মতো ইভেন্ট। দেখো, মন উদার হলে কারো কলা খাওয়া দেখতেও আনন্দ। কেউ শুধু হাঁটছে তাতেও আছে আমোদ। গুনো, বোলারের বল কয়টা ড্রপ খায়।
মানুষের মৃত্যু দেখে না হেসে এসব দেখে হাসো। লোকজনকে ফরোয়ার্ড করে হাসাও। তাদেরকেও বলো আরো লোকজনকে ফরোয়ার্ড করতে।
হোয়াই সো সিরিয়াস ম্যান?
লেখক : সাহিত্যিক