রাজনীতি

নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ‘এ টু জেড’ মানি না -ডা. শফিকুর রহমান

জাতীয় নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত নারী কমিশন এবং কমিশনের প্রতিবেদনে করা সুপারিশ ‘এ টু জেড’ মানি না। এ কমিশন ও কমিশনের প্রতিবেদন পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করছি। এ কমিশন জাতির চিন্তা-চেতনা, তজিব-তামাদ্দুন এবং বিশেষ করে আল্লাহ তায়ালার আইনের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে এ কমিশন ও কমিশনের সুপারিশ প্রত্যাখ্যাত বলে আমরা ঘোষণা করছি। এদের রিপোর্ট বাতিল করা কোনো ব্যাপার নয়, এদেরই আগে প্রত্যাখ্যান হলো, এ রিপোর্টও এখানেই শেষ।
জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের উদ্যোগে গত ৩০ এপ্রিল বুধবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের ইসলামফোবিয়া : করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে অংশ নিয়ে তিনি দলের এ অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেন।
জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের সভাপতি মাওলানা নুরুল হুদা ফয়েজির সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইএফএ কনসালটেন্সি লিমিটেডের পরিচালক মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম। এতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আমীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মামুনুল হক, এনসিপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা আশরাফ মাহদী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মনজুরুল ইসলাম আফেন্দী, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাগ আইয়ুবী, মাওলানা আবদুল্লাব বিন আবদুর রাজ্জাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম অপু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমাদেরকে একটু ভাবতে হবে যে আমাদের কোনপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করে চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের শিশুকালে আমরা দেখেছি আমাদের শিক্ষাকাল শুরু হতো মক্তবের পাঠ দিয়ে। সকালে মক্তবে যেতাম, সেখান থেকে আসার পর মা গোসল করিয়ে, কাপড় পরিয়ে স্কুলে পাঠাতো। এখন খুবই পরিকল্পিতভাবে সকালের মক্তবে যাওয়ার এ ধারাকে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চা ঘুমাচ্ছে মা তাকে কাঁধে তুলে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন। মক্তবের সময় এভাবেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যেখানে মুসলমানের সন্তান ‘ইকরা বি-ইসমি রব্বিকাল্লাজি খোলাক’ দিয়ে পাঠ শুরু হওয়ার কথা, সেখানে অন্য কিছু দিয়ে পাঠ শুরু হচ্ছে, এই জায়গাটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রজন্মেরই কিছু লোক আজ গোটা নারী সমাজের প্রতিনিধিত্বের কথা বলে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি পাঁয়তারা করছে। তারা কারা যে কুরআনের সংস্কারের দাবি নিয়ে আমাদের সামনে এসেছেন? আমাদের কি অধিকার আছে তাদের এ অধিকার দেওয়ার, আমরা কে? এই কুরআন আল্লাহ নাজিল করেছেন, এর হেফাজতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন। কিয়ামত পর্যন্ত কেউ এর পরিবর্তন আনতে পারবে না। এরা এত দুঃসাহস কীভাবে দেখালো যে, বাংলাদেশে কুরআনের আয়াত পরিবর্তন করে দিতে চায়? নিশ্চয়ই তাদের পেছনে কোনো উসকানিদাতা রয়েছে। কিন্তু কেন? এ মুহূর্তে কেন এ উসকানি? এখন এমন এজেন্ডা আসার কথা নয়, আরও গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা রয়ে গেছে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, এ সমাজকে কুরে কুরে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এখন এদেশে দীনদ্বার, ঈমানদার যে শক্তিটা জেগে উঠেছে, তা নিয়ে মানুষ প্রচণ্ডভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। এ জায়গায় ইসলামী শক্তির মুখোমুখি আরেকটি শক্তিকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অতীতের সকল ষড়যন্ত্র মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করেছে। ইনশাআল্লাহ এ চক্রান্তও টিকবে না, এটাও ভেসে যাবে, ইনশাআল্লাহ। আমীরে জামায়াত নারী কমিশনকে উদ্দেশ করে বলেন, এরা শুধু কুরআনের বিরোধী না এরা স্ববিরোধীও বটে, একদিকে এরা বলছে নারী-পুরুষের সমান অধিকার; অন্যদিকে বলছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা নির্ধারণ করতে হবে। এটা স্বরিবোধী হয়ে গেল না। সমান অধিকার চাইলে কোটার প্রশ্ন আসবে কেন? প্রশ্ন রাখেন আমীরে জামায়াত। যোগ্যতা প্রমাণ করে নিজ নিজ জায়গায় চলে গেলে তো কোটার দরকার হয় না। কোটা দেওয়া হয় পিছিয়ে পড়াদের সুযোগ দেওয়ার জন্য। নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই, নারীরা আমাদের মা, আমাদের বোন, আমাদের কন্যা।
নারীরা সম্মানের প্রতীক উল্লেখ করে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, গঠিত নারী কমিশন পরিবারে পরিবারে দাঙ্গা লাগাতে চায়। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে রেপ আনা হলো কেন? এরা পরিবারগুলোর মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে আদালতগুলোক পরিপূর্ণ করতে চায়।
এরা সমাজে বিপর্যয়ের জন্য এ প্রস্তাবনাগুলো এনেছে। আমরা আবারও বলি, ‘এ টু জেড’ এই কমিশনই মানি না। কীসের আবার রিপোর্ট, কমিশন থাকলে না রিপোর্টের প্রশ্ন আসবে। ঈমান-আকিদা, তাহজীব-তামাদ্দুনে যারা বিশ্বাস করেন, তাদের বাদ দিয়ে নয়, তাদের প্রধান্য দিয়েই এ কমিশন গঠন করতে হবে। দুঃখজনক হলো এ কমিশনে এমন একজন নারীকেও রাখা হয়নি। এখানেই এটা পক্ষপাত দুষ্টু। আমরা এটা মনবো না, আমাদের সাফ কথা এটা আমরা মানবো না। আমরা এটা নিয়ে কোনো আন্দোলনে যেতে চাই না, কিন্তু যদি আমাদের বাধ্য করা হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা আন্দোলনে যাবো।
বক্তৃতার এ পর্যায়ে আমীরে জামায়াত এ সেমিনার আয়োজনের ওপর দলের পক্ষ থেকে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আগামী দিনে আমরা হাতে হাত ধরে সমাজের সকল কল্যাণকর কাজ একসাথে করবো, ইনশাআল্লাহ এবং আমরা এ বার্তা দিচ্ছি, তোমরা আমাদের টুকরা টুকরা করে আমাদের মাথায় আর কাঁঠাল ভেঙে খেতে পারবে না। আগামীর বাংলাদেশ হবে কুরআনের বাংলাদেশÑ এ প্রত্যাশা রেখে বক্তব্য শেষ করেন আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান।
সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, নারী কমিশন প্রস্তাবনার মাধ্যমে নাস্তিকতা বাস্তবায়নের যে হীন চেষ্টা করছে, তা আমাদের প্রজন্ম কখনোই মেনে নেবে না। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছরে নাস্তিকরা এবং ইসলামবিদ্বেষীরা নানাভাবে ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হয়নি। এরাও জানে যে, ষড়যন্ত্র সফল হবে না কিন্তু তারপরও কেন এটা তারা করছে। তিনি বলেন, আমার মনে হয় আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের চক্রান্ত রয়েছে এতে। ফ্যাসিস্টরা বসে নেই, তারা এ নারী কমিশনের মাধ্যমে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। আর এই ফাঁকে তারা (আওয়ামী লীগ) রাস্তায় নেমে হীন চক্রান্ত চারিতার্থ করতে চায়। এটা এদেশের মানুষ কখনোই মেনে নেবে না।
সেমিনারে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী ও আলেমসমাজ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সরকার পতিত স্বৈরাচারের জঞ্জাল পরিষ্কারের লক্ষ্যে যে সামগ্রিক সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা জনসমর্থনপুষ্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল বটে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের মতো কিছু কমিশন জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। কিন্তু নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন যে সুপারিশমালা পেশ করেছে, তা দেশের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং সরাসরি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। বক্তারা বলেন, এ কমিশনের বেশকিছু সুপারিশ এমন, যা পশ্চিমা মতবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা, নারীসমাজের প্রকৃত চাহিদা ও জীবন সংগ্রামের সম্পূর্ণ বিপরীত। নারী-পাচার, যৌন নিপীড়ন ও দারিদ্র্যজনিত কারণে যারা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের পুনর্বাসন ও সমাজে স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করার কথা থাকলেও কমিশন বরং এ ব্যাধিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নারীর জন্য অভিশপ্ত জীবনকে আইনি বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের পারিবারিক আইন বহুদিন ধরে ধর্মভিত্তিক। যেমনÑ মুসলিম পারিবারিক আইন, হিন্দু পারিবারিক আইন, খ্রিস্টান পারিবারিক আইন। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং ভারতের মতো বহু দেশেই প্রচলিত। এ আইনের মাধ্যমে পরিবার গঠিত হয় এবং তা নিয়ে কোনো বড় অসন্তোষও সমাজে নেই। অথচ নারী কমিশন এ ধর্মীয় ভিত্তিকে বাতিল করে নতুন আইনের নামে ধর্মহীন পরিবার কাঠামো চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে তারা ধর্মবিশ্বাসী জনগণকে উত্তেজিত করে ভারতের বিজেপির সাম্প্রতিক সামাজিক বিভাজনের কৌশলের অনুকরণ করছে বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধে বলা হয়, নারীর জন্য কল্যাণকর প্রস্তাবনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত, তাদের সম্মান, নিরাপত্তা ও পারিবারিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। অথচ কমিশন যে ভাষায় ও যুক্তিতে তাদের প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে, তা পশ্চিমা দর্শনেরই বিকৃত প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের নারীরা এ ধরনের ভাষা ও মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে না। বক্তাগণ প্রশ্ন করেন, সরকার যে নারীদের কল্যাণে কমিশন গঠন করেছে, সেখানে কীভাবে সবাই একমুখী, ইসলামবিরোধী এবং পাশ্চাত্য চিন্তায় প্রভাবিত হলো?
সেমিনারে বক্তাগণ বলেন, এ প্রস্তাব জনরোষ উসকে দেবে এবং এর সুযোগ নিয়ে পতিত ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। একটি গণআন্দোলননির্ভর সরকারকে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর কমিশন বিপদে ফেলবে। সেমিনারে আলোচকগণ এ কমিশনের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে কমিশন বাতিলের দাবি জানান এবং দেশের নারীদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী দীনদার, শিক্ষিত ও সমাজসচেতন নারীদের সমন্বয়ে নতুন কমিশন গঠনের আহ্বান জানান।
সেমিনারে সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নোক্ত দাবিসমূহ পেশ করা হয়: এক. নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের বিতর্কিত প্রস্তাব অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। দুই. ২. কমিশন সরকারিভাবে বাতিল করতে হবে। তিন. নতুন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে দীনদার, শিক্ষিত, দেশীয় চিন্তায় বিশ্বাসী নারীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। চার. পরিবার ও নারী বিষয়ে প্রস্তাবের ভিত্তি হতে হবে কুরআন-সুন্নাহ, সংবিধান এবং সামাজিক বাস্তবতা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button