উত্তরায় প্রতারক চক্রের ৫ সদস্য আটক
চাকরির লোভ দেখিয়ে অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে টাকা আদায়

মুক্তমন রিপোর্ট : টার্গেট নিম্নবিত্ত পরিবারের তরুণী-কিশোরী ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অসচ্ছল ছাত্রী। ‘বায়িং হাউসে’ চাকরির লোভ দেখিয়ে ডেকে আনা হতো। এরপর মাদক সেবন করিয়ে নগ্ন ছবি-ভিডিও ধারণ করা হতো। সেসব ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের টাকা।
গত বুধবার (২৮ মে) রাতে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের মূল হোতা মাসুম পারভেজসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পারভেজ মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট। কিন্তু তিনি মুগদা মেডিকেলে বসতেন না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি কথিত এই বায়িং হাউসে সময় কাটাতেন।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন চক্রের মূল হোতা টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার চরশিমলা গ্রামের মাসুম পারভেজ (৩৮), একই উপজেলার ছাতারকান্দি গ্রামের সোলাইমান হোসেন (৩৮), বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রায়েরবাড়ি দেরগতি গ্রামের শফিকুল ইসলাম সৌরভ (২৭), নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার পাংখাচর গ্রামের মেয়েরুলি খানম (১৯) ও শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার পশ্চিম পাগলাজামি গ্রামের মোছা. মায়া (২৫)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ওই কথিত বায়িং হাউসটিতে চারটি রুম রয়েছে। যার মধ্যে একটি রুমে ডিজে পার্টি করার জন্য সব ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সঙ্গে মাদক সেবন ও যৌন নিপীড়ন করার জন্যও নানা ব্যবস্থা আছে। বাকি কক্ষে আছে লোকদেখানো আসবাবপত্র।
অভিযানকালে চক্রের আস্তানা থেকে ১ কোটি ৪১ লাখ টাকা, ৬০ পিস ইয়াবা, পর্নো ভিডিও ধারণে ব্যবহৃত দুটি হোম সিসিটিভি ক্যামেরা, তিনটি মোবাইল ফোন ও বহু বিদেশি মদের বোতল জব্দ করা হয়।
এক কিশোরীর মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে এ চক্র। ওই কিশোরীর মা পুলিশের কাছে মৌখিকভাবে অভিযোগের পর গ্রেপ্তার পাঁচজনসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে (ফুসলাইয়া অপহরণ করে আটক রেখে মুক্তিপণ দাবি) মামলা করেন।
মামলার এজাহারে ওই নারী উল্লেখ করেন, ২৬ মে বিকেলে তাঁর মেয়ে ঘুরতে বের হওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। পরে বাসায় না ফেরায় দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ফোনে কল করা হলেও ধরেনি, পরে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিন দুপুরে ফোন করে টাকা চায়। তাঁর অবস্থান বা টাকা দাবির কারণ জানতে চাইলে বাসা থেকে টাকা নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ফের মোবাইল বন্ধ করে দেন। ২৮ মে গভীর রাতে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি ফোন করে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন এবং টাকা না দিলে মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি দেন। তাঁরা টাকা নিয়ে উত্তরার শহীদ মুনসুর আলী মেডিকেলের সামনে যেতে বলেন। পরে তাঁরা উত্তরা পশ্চিম থানা-পুলিশকে জানালে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই কিশোরীকে উদ্ধার ও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে।
উদ্ধারের পর জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটি জানান, বাসা থেকে বের হওয়ার পর মধুমিতা নামের এক মেয়ে বায়িং হাউসে চাকরি দেওয়ার কথা বলে উত্তরা যেতে বলেন। সেখানে যাওয়ার পর সোহেল নামের এক ব্যক্তি তাঁকে রুমে ডেকে নিয়ে উলঙ্গ করে দৃশ্য ধারণ করেন এবং বলেন, ব্যবসার কাজে লাগবে। পরে সেসব ছবি ও ভিডিও দেখিয়ে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। টাকা না দিলে এসব ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন তাঁরা। সেই সঙ্গে তাঁকে একটি রুমে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।
অপরদিকে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করা ও ইয়াবা জব্দের ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবু সাঈদ বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করেন।
পর্নোগ্রাফি আইনে করা মামলার এজাহারে আবু সাঈদ জানান, আসামি মাসুম পারভেজ, সোলাইমান হোসেন ও শফিকুল ইসলাম সৌরভের মোবাইল ফোন থেকে ভুক্তভোগী ওই কিশোরীসহ বহু মেয়ের অশ্লীল ভিডিও ধারণ করা রয়েছে। এসব ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে তাঁরা টাকা আদায় করতেন। এভাবে আদায় করা ১ কোটি ৪১ লাখ টাকাও তাঁদের হেফাজত থেকে জব্দ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরাও তা স্বীকার করেছেন।
অপরদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, তরুণীদের ধারণ করা পর্নো ভিডিও চড়া মূল্যে বিদেশি বিভিন্ন পর্নো সাইটে বিক্রি করা হতো।
এ বিষয়ে ডিএমপির উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, চক্রটির পাঁচজন সদস্য মিলে একটি কথিত বায়িং হাউস দেন। তাঁদের ছিল একটি নারী সিন্ডিকেট। নারীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রী ও নিম্নবিত্ত পরিবারের তরুণীদের পার্ট টাইম চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ডেকে নিয়ে আসতেন। সেখানে নিয়ে এসে উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে চক্রটি বলত, তাঁদের বিদেশি বায়ারদের ফেস করতে হবে। এর জন্য ফিগার দেখাতে হবে। তারপর নগ্ন করে তাঁদের ছবি ও ভিডিও ধারণ করা হতো। তাঁদের মদ-ইয়াবা সেবন করাত। আবার সেই দৃশ্যও ধারণ করে রাখা হতো।
চক্রটির কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওসি হাফিজ বলেন, প্রায় দেড় বছর ধরে চক্রটি বায়িং হাউসের আড়ালে এমন কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। চক্রটিতে মোট আটজন সদস্য রয়েছেন। যার মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পলাতক তিনজনকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ওসি হাফিজ বলেন, বায়িং হাউসের অন্তরালে গড়ে তোলা হয়েছিল পতিতালয়। কোনো তরুণী সেখান থেকে চলে যেতে চাইলে তখন তাঁকে সেসব নগ্ন ছবি-ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে নোংরা কাজে বাধ্য করা হতো। অন্যথায় তাঁর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত। আর যেসব তরুণী বাধ্য হয়ে সেখানে থাকতেন, তাঁদের দিয়ে করানো হতো পতিতাবৃত্তি।
ভুক্তভোগীর সংখ্যা ও ধারণ করা ভিডিও প্রসঙ্গ জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা হাফিজ বলেন, ‘তাদের হেফাজত থেকে শত শত কিশোর-তরুণীর নগ্ন ছবি ও ভিডিও পেয়েছি। যা দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে ধারণা করছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছি। আগামীকাল সোমবার রিমান্ড শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়েছে। রিমান্ড মঞ্জুর হলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।’